বল বীর—
আমি চির-উন্নত শির। ’
সীমাহীন সংকট আর ষড়যন্ত্র পেরিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ সুসম্পন্ন করে বাঙালি জাতির শির দ্বিতীয়বার সমুন্নত রাখতে পারার মাধ্যমে নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অভিনন্দন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বাঙালি জাতির শির চির-উন্নত রাখার শিক্ষা দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিজ্ঞাপন
বিস্ময়ের বিস্ময়; বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি সমর্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাঙালি জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাস রচিত হয়।
৫১ বছরের মাথায় এসে বাঙালি জাতির জন্য দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ইতিহাস রচনা করলেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ রকম অসাধারণ জাতীয় অর্জনে নেতৃত্বের অসাধারণত্ব বোঝা যায়। তাই এ রকম সাফল্যে শেকসপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ নাটকের সেই বিখ্যাত সংলাপটির কথা মনে পড়ে, ‘টু বি অর নট টু বি। ’ চিরন্তন এই দ্বন্দ্বমূলক প্রশ্নে যে নেতৃত্ব সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, তাঁরাই ইতিহাস সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছিলেন বলেই চির-বিস্ময়ের বিস্ময় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ২০১২ সালে ষড়যন্ত্রমূলক মহামিথ্যা অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর জাতির সামনে সেই চিরন্তন প্রশ্ন আসে, ‘টু বি অর নট টু বি। ’ বঙ্গবন্ধুর মেয়ে তিনি। মাথা নোয়াবার নয়। বড় বড় পণ্ডিত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের চরম হুঁশিয়ারি ও সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হবে, নিজস্ব অর্থায়নে হবে। কত ষড়যন্ত্র, কত বিরোধিতা—সব পেরিয়ে শেখ হাসিনার সংকল্পের সফলতায় বাংলাদেশের মানুষ আজ মুগ্ধ। বিশ্বব্যাপী বাঙালি আজ আনন্দের জোয়ারে ভাসছে।
এমন আনন্দের চিত্র এই এক জীবনে আমাদের জন্য দুইবার দেখার সৌভাগ্য হলো। প্রথমবার দেখেছি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার দুঃখ, বেদনা, কষ্ট সব ভুলে সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে জয় বাংলা স্লোগানে স্লোগানে বাঙালি জাতি আনন্দের জোয়ারে ভেসেছিল। এবার ২৫ জুন ফের সে রকমই আরেকটি চিত্র দেখলাম। পদ্মাপারে শুধু নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিসহ বিশ্বব্যাপী যে যেখানে আছে, সেখান থেকেই আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণোচ্ছ্বাসে পূর্ণ আনন্দের একটা অসীম অসাধারণ অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, যা সব বাধা ভেঙে দিতে পারে। তাই পদ্মা সেতু সুসম্পন্ন হওয়ার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেমন তার বিশাল প্রভাব পড়বে, তেমনি বাংলাদেশকে ঘিরে আঞ্চলিক এবং সেই পথ ধরে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির ওপরও পদ্মা সেতু নতুন আলো ফেলবে। কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরি।
প্রথমে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সত্যি এক বিস্ময়কর ব্যাপার। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর ধরে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বগাথা ও ইতিহাস এবং বিশ্বনন্দিত, কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ, যা বাহাত্তরের সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়—এসবের কিছুই বিএনপি ও তার জোটবন্ধুরা মানে না, সম্মান দেখায় না। এর পরও তারা রাজনীতি করছে, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেছে। এটি কি সত্যি বিস্ময়কর নয়! কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চরম বিরোধী, পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি আজকে ফের দ্বিতীয়বার পরাজিত হলো, যেমনটি হয়েছিল প্রথমবার একাত্তরে। তাই ২৫ জুন বিকেল থেকে যে সুবাতাস পাচ্ছি, তাতে দেখছি দলীয় অন্ধত্বে নয়, যারা নিজস্ব জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে এবং নাম শুনতে পারে না, তাদের একটি অংশও আজ বলতে বাধ্য হচ্ছে, শেখ হাসিনা সত্যি পেরেছেন, তিনি পারেন। জাতীয় নেতৃত্বের বিশাল স্বীকৃতি। সে জন্যই লেখার একদম শুরুতে বলেছি, শেখ হাসিনা নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। দক্ষিণ অঞ্চলের ২১ জেলায় যাঁরা বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মী রয়েছেন, তাঁদের মুখেও শোনা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ এই পদ্মা সেতু করতে পারতেন না। সুতরাং আগামীর রাজনীতিতে এর একটি প্রভাব থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক।
এবার ভূ-রাজনীতির কথায় আসি। বিশ্বমানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, পূর্ব ইউরোপ থেকে ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতু হয়ে ইরান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ এবং বর্ধিত হয়ে চীনের সাংহাই, ভিয়েতনাম ও মালাক্কা বন্দর পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল পদ্মা নদী। এখন সেটি আর থাকল না। বাণিজ্যের প্রধান পথ এখনো সমুদ্র। সংগত কারণে সেটি অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ এবং খরচও বেশি। এ কারণেই প্রতিটি দেশ অভ্যন্তরীণভাবে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য সড়ক ও রেলপথের কানেক্টিভিটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। চীন সাংহাই থেকে স্থলপথে মধ্য এশিয়া হয়ে পশ্চিম ইউরোপের বেলজিয়াম পর্যন্ত এরই মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপন করে ফেলেছে। পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ তৈরির জন্য চীন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। সুতরাং পদ্মা সেতু হওয়ায় প্রথমে আঞ্চলিক এবং পরে বর্ধিত হয়ে পুরো এশিয়া ও আন্তর্মহাদেশীয় স্থল কানেক্টিভিটির পথ সুগম হয়ে গেল। এরপর শুধু প্রয়োজন আন্তর্দেশীয় বোঝাপড়া ও সমঝোতা।
এশিয়ান হাইওয়ে-১-এর অন্যতম ফোকাল পয়েন্ট হবে পদ্মা সেতু। এতে পুরো এশিয়ার মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন শুধু নয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। এক লাখ ৪৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এশিয়ান হাইওয়ে রুট-১-এর সঙ্গে ৩২টি দেশের সংযোগ স্থাপিত হবে। বাংলাদেশ তিনটি এশিয়ান কানেক্টিভিটি রুটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে; এশিয়ান হাইওয়ে রুট-১, ২ ও ৪১। বাংলাদেশের মধ্যে যার সম্মিলিত অংশের দৈর্ঘ্য হবে এক হাজার ৭৭১ কিলোমিটার। এত দেশের শত শত গাড়ি ও রেলবগি দৈনিক এত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যে টোল বাংলাদেশকে দেবে সেটি বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলকে বড়ভাবে স্ফীত করবে। এশিয়ান হাইওয়ে রুট-১ আসাম থেকে তামাবিল দিয়ে সিলেট-ঢাকা-নড়াইল-যশোর-বেনাপোল-ভারতের পেট্রাপোল হয়ে পশ্চিম এশিয়ার দিকে ধাবিত হবে।
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে এশিয়ান হাইওয়ের জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০০৯ সালের ৫ জুলাই বাংলাদেশ এই রুটগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়। একইভাবে ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে ২৮টি দেশ সংযুক্ত থাকবে, যার মোট দৈর্ঘ্য হবে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এই রেল রুটের জন্য পদ্মা সেতু হবে নোডাল পয়েন্ট। একসময় এসব যখন পরিপূর্ণতা পাবে, তখন পদ্মা সেতুর দুই পারে গড়ে উঠবে বড় বড় শিল্প-কারখানা, আধুনিক শহর, হোটেল ইত্যাদি। এতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাই পদ্মা সেতু শুধু একটি সাধারণ সেতু নয়, এর বহুমাত্রিক গুরুত্ব রয়েছে, যার গণ্ডি বাংলাদেশের বাইরেও বিস্তৃত। ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির মেরুকরণ ও সমীকরণ বদলে যাওয়ার লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। চীন-ভারতের সম্পর্কে বরফ গলা শুরু হয়েছে। টাইমস নার্ড নামের ভারতের একটি জনপ্রিয় সংবাদ চ্যানেলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. জয়শঙ্করের একটি সাক্ষাৎকার দেখলাম। এতে তিনি বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সমস্যা রয়েছে, তবে সেটি দেখভাল করার জন্য ভারত একাই যথেষ্ট, অন্য কারো সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন নেই। ’ এটিকে প্যারাডাইস শিফট বলছেন অনেকে। চীন এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে।
জয়শঙ্কর আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বলেছেন, ইউরোপের সমস্যাকে ইউরোপবাসী বিশ্বের সমস্যা মনে করে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য সমস্যাকে ইউরোপ নিজেদের সমস্যা মনে করে না। তিনি আরো বলেছেন, আগামী দিনে ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন হবে, যে কথা চীন বহু আগে থেকে বলে আসছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনাকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চীন-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রচণ্ড তুষারপাত হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বাধেনি, যেটি দুই দেশের নেতৃত্বের দূরদর্শিতা প্রমাণ করে। একই সঙ্গে সীমান্তে প্রচণ্ড উত্তেজনা সত্ত্বেও দুই দেশে বাণিজ্য কিন্তু বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে এসে তার পরিমাণ ১২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সুতরাং ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের উহান সফরের পর চীন-ভারত সম্পর্কের মধ্যে যে সুঘ্রাণের বাতাবরণ তৈরি হয়, সেটি আবার ফিরে এলে পুরো এশিয়া অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক আবহাওয়ার বিশাল পরিবর্তন ঘটবে। সেই পরিবর্তনের ঢেউ এসে পড়বে পদ্মা সেতুর ওপর। বিসিআইএম—বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর অত্যন্ত ভাইব্রান্ট একটি সংস্থা হিসেবে কাজ করবে।
ভারত-বাংলাদেশ সড়ক ও রেলপথে মিয়ানমার হয়ে সাংহাইসহ চীনের বড় বড় বাণিজ্যকেন্দ্র ও বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত হবে, চলাচল করবে। ভারত ও বাংলাদেশের জন্য চীনের সঙ্গে পরিচালিত বাণিজ্যিক বহরের সময় ও খরচ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। ভারত, চীন, মিয়ানমার পদ্মা সেতু ব্যবহার করবে। এতে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে তা-ই নয়, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথও খুলে যেতে পারে। বিসিআইএম ভাইব্রান্ট হলে বিমসটেকও একই সঙ্গে ভাইব্রান্ট হবে। বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ ছয় দেশের বিমসটেক সক্রিয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলে ভবিষ্যতে এর সঙ্গে চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশও যোগদান করবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের বাজারে প্রবেশের জন্য শর্টকাট ও সহজ পথ হিসেবে বেছে নেবে এশিয়ান হাইওয়ে, সেখানে সবাই পদ্মা সেতু ব্যবহার করবে। এশিয়ায় তখন ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ডিসাইডিং কান্ট্রি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। সুতরাং পদ্মা সেতুর যেমন অভ্যন্তরীণ গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে বহুমাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ বহু দেশের নেতারা বাংলাদেশের এই সফলতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাই পদ্মা সেতু সুসম্পন্নের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে তিনি বিশ্বের বুকে পর্বতসম শিখরে উঠিয়েছেন।