ব্যক্তি খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগ ব্যতীত কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুততর ও টেকসই হতে পারে না। বিশ্বের যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি অর্জন করেছে, তাদের সবাই ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদনশীল খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশও শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি খাতের ওপর গুরুত্বারোপ করে চলেছে। কিন্তু ব্যক্তি খাত ততটা অগ্রগতি অর্জন করতে পারছে না, যতটা প্রত্যাশা করা হয়। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কারণ দায়ী। এর মধ্যে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটি বড় কারণ। আমি অনেকদিন ধরেই দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বলে আসছি। আমাদের দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং আগের চেয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মাত্রা আরো অনেক বেড়ে গেছে। কাজেই বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে, তা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না। স্থানীয় বা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগ করার আগে সেখানে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে কি না, তা নিশ্চিত হতে চাইবে। কারণ বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত। বিনিয়োগের সঙ্গে পরিবহন সেক্টরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বিনিয়োগ করতে গেলেই নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিনিয়োগের জন্য শুধু অর্থ থাকলেই চলে না। কারখানার জন্য মেশিনারিজ আনতে হয়। কাঁচামাল আনতে হবে। উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি, যেমন—হরতাল-ধর্মঘটের কারণে রাস্তা বন্ধ থাকলে পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে যখন অনিশ্চয়তা বিরাজ করে, তখন উদ্যোক্তাগণ মনে করেন আমি কেন বিনিয়োগ করে কেন ঝুঁকি নিতে যাব। একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য তা থেকে মুনাফা অর্জিত হতে হয়তো দুই-তিন বছর সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি কেমন থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যারা সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী তাদের প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জনের বিষয়টি খুবই অনিশ্চিত।
চাঁদাবাজি বা অন্য কোনোভাবে বিনিয়োগকারীদের হয়রানি করার বিষয়টিও আছে। তবে ম্যাক্রো ইকোনমিক প্রেক্ষিতে সেটা খুব একটা বড় কিছু নয়। কোনো কোনো অঞ্চলে শিল্পকারখানায় চাঁদাবাজি হচ্ছে, এটা ঠিক। চাঁদাবাজির বিষয়টি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের একশ্রেণির নেতাকর্মীর দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের পরিচয়দানকারী কিছু চাঁদাবাজি হয়তো কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করছে।
আমি একসময় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছি। দেশে শেয়ার মার্কেট যেভাবে উন্নয়ন ঘটার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। শেয়ার বাজারের উন্নয়নের ইস্যুটি অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন ফোরামে আলোচিত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের স্টক মার্কেটের যে অবস্থা বিরাজ করছে তাকে নিম্ন পর্যায়ের স্থিতিশীলতা বলা যেতে পারে। ইনডেক্স খুব একটা নামছেও না, আবার বাড়ছেও না। বাজারে ভালো মৌল ভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির অভাব রয়েছে। কাজেই শেয়ার বাজারকে প্রত্যাশিত মাত্রায় উন্নয়ন ঘটাতে হলে প্রথমেই ভালো কোম্পানিকে বাজারে আনতে হবে। প্রতিবেশী দেশ নেপালের অর্থনীতি আমাদের তুলনায় অনেক ছোট। তার পরও তাদের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা আমাদের দেশের চেয়ে বেশি। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ভালো ভালো কোম্পানিগুলো যাতে বাজারে আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন উভয় খাত থেকেই ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। শুধু কোম্পানি বাজারে আনলেই হবে না। সেই কোম্পানিগুলো যাতে ভালো মৌল ভিত্তিসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার সময়কালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি ২৬ কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, যাদের শেয়ার বাজারে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু নানা কারণে সেই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বিএসইসি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রণালয় সবাইকে মিলি প্রো-অ্যাকটিভ রোল প্লে করতে হবে। আমি উদাহরণ হিসেবে তিতাস গ্যাস কোম্পানির প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন তিতাস গ্যাস কোম্পানির শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করি। সেই সময় শুরুতে অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। বিশেষ করে, প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে আপত্তি উত্থাপন করা হয়। আমাদের দেশে শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে অনেক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পরিচালিত হয়। শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায় না। স্টক মার্কেটে শেয়ার ছাড়া হলে বাইরের শেয়ার হোল্ডারগণ আসবেন। তারা নানাভাবে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেন। প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে জবাবদিহিতা সৃষ্টি হবে। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, কোম্পানির মোট যে শেয়ার তার মধ্যে ১০ শতাংশ কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এই সিদ্ধান্তের পর কর্মচারীরা শান্ত হয়। আমি মনে করি, যে কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করেই হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভালো কোম্পানিগুলোকে শেয়ার মার্কেটে নিয়ে আসতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেকগুলো কোম্পানি গড়ে উঠেছে। তারা ভালো ব্যবসায় করছে। সাধারণ মানুষ এসব কোম্পানির ওপর আস্থাশীল। এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে যে কোনো মূল্যেই হোক, বাজারে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে উচ্চ প্রিমিয়াম দিয়ে হলেও তাদের বাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। বার্জার পেইন্ট আমার আমলে শেয়ার বাজারে এসেছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, তাদের ২০০ ভাগ পর্যন্ত প্রিমিয়াম দেওয়া হয়েছিল। বার্জার পেইন্টের শেয়ারের মূল্য এখনো প্রিমিয়ামের ওপরে আছে। বার্জার পেইন্ট একটি বহুজাতিক এবং ভালো কোম্পানি। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের প্রতি বেশ আগ্রহী। আমি মনে করি, ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
বড় বড় কোম্পানির উদ্যোক্তাদের অনেকেই মনে করেন, তাদের কোম্পানি শেয়ার বাজারে এলে কোম্পানির ওপর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যেতে পারে। এছাড়া নানা পর্যায়ে জবাবদিহি করতে হবে। ভালো কোম্পানি শেয়ার বাজারে না-আসার ক্ষেত্রে এই নেতিবাচক মনোভাব কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে যারা উদ্যোক্তা, তারা সব সময়ই চান তাদের কোম্পানির ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকুক। সেখানে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে, যেহেতু কোম্পানির বেশির ভাগ শেয়ার তাদের মালিকানায় থাকবে, কাজেই কোম্পানির ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতেই থাকবে। তাদের বোঝাতে হবে, আপনি যদি শেয়ার বাজারে আসেন, তাহলে কোম্পানির ইমেজ বৃদ্ধি পাবে। গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। কোম্পানির বাজার সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কোনো কোম্পানি শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির ভালোমন্দ নিয়ে উদ্যোক্তাগণ সব সময়ই সচেতন থাকবেন। প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য ব্যাংকনির্ভরতা অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে। যেহেতু শেয়ার হোল্ডারদের কাছে কোম্পানির কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তাই তারা চেষ্টা করবে কোম্পানির কার্যক্রমে যাতে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি না থাকে।
উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য উদ্যোক্তাগণ ব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে শেয়ার বাজারের ওপর নির্ভর করেন। উন্নত দেশগুলোতে পুঁজি সংগ্রহের অনেক মাধ্যম থাকে। তারা স্বল্পমেয়াদি অর্থায়ন সংগ্রহের জন্য ব্যাংকের কাছে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সংগ্রহ করে সাধারণত শেয়ার মার্কেট থেকে। ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে যদি শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে। যেমন—কোনো ঋণের কিস্তি হয়তো ছয় মাস পর শুরু হবে। কিন্তু কোম্পানিটি উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করল তিন বছর পর। তাহলে উৎপাদন শুরু হওয়ার আগেই কোম্পানিটি ঋণখেলাপিতে পরিণত হবে। কারণ গৃহীত ঋণের সুফল পেতে তার তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ব্যাংক তো ঋণের কিস্তি আদায়ের জন্য তিন বছর অপেক্ষা করবে না। অনেক প্রকল্প এভাবে শুরুতেই হোঁচট খায়। আমাদের যে কোনো মূল্যেই হোক, এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে, যাতে উদ্যোক্তাগণ তাদের প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য ব্যাংকনির্ভর না হয়ে শেয়ার বাজারমুখী হতে পারে। এজন্য উদ্যোক্তাদের বোঝাতে হবে। আমি মনে করি, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ ভিত্তিতে বসতে হবে। শেয়ার বাজার থেকে অর্থায়ন সংগ্রহের ভালো দিকগুলো তাদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, শেয়ার বাজারে আসাটা ভবিষ্যতে আপনাদের জন্য লাভজনকই হবে।
বিদেশে রোড শো করার মাধ্যমে বিনিয়োগ আহরণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ খুব একটা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। আমি বিএসইসির চেয়ারম্যান থাকাকালে অনেকেই বলেছিলেন, কিন্তু আমি কোনো ‘রোড শো’তে যাইনি। ‘রোড শো’তে গিয়ে আপনি কী বলবেন? আমরা এত সুবিধা দিচ্ছি, তোমরা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করো। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা বিদেশি বিনিয়োগকারী, তারা কোনো দেশে বিনিয়োগের আগে, সেই দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবেই খোঁজখবর নেন। তারপরই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন, অবকাঠামোগত অবস্থা কেমন, এনার্জি সেক্টরের পরিস্থিতি কেমন, সামাজিক অবস্থা কেমন, এসব বিষয় তারা আগে থেকেই ভালোভাবে অনুসন্ধান করেন। তারপর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কাজেই বিদেশে রোড শো করে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষিত করার চেষ্টা করে তেমন একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না।
মাঝেমধ্যেই শেয়ার বাজারে ম্যানিপুলেশনের খবর পাওয়া যায়। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাজারে ম্যানিপুলেশন হবে বিনিয়োগকারীরা আস্থা সংকটে পড়বে। কাজেই কারো বিরুদ্ধে বাজারে কারচুপি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।