ডলারের দাম বাড়াসহ আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্য এবং পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর চলতি মূলধন ঋণসীমার সর্বোচ্চ ব্যবহার সত্ত্বেও চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মূল্য পরিশোধসহ উৎপাদন কার্যক্রম করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানিসহ চলমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের দেওয়া ঋণের চলতি মূলধনের (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) সীমা বাড়াচ্ছে না অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক। উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি ঋণের চাহিদা থাকলেও তা দিতে অপারগতা জানাচ্ছে তারা। সব মিলে ঋণের লিমিট না বাড়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এ অবস্থায় ব্যাংকের চলতি মূলধনের সীমা বাড়ানো না হলে উৎপাদন চালিয়ে রাখা কঠিন হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না বেশির ভাগ ব্যাংক।
সম্প্রতি বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উদ্যোক্তাদের উৎপাদনে ব্যবহার করা কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অফিস ভাড়া ও অন্যান্য সরঞ্জামসংক্রান্ত ব্যয়ের বোঝা বাড়তে থাকায় আগামী দিনগুলোতে তাদের কপালের ভাঁজ আরো চওড়া হতে পারে। এই অবস্থায় ব্যবসায় টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ বাড়বে এবং মুনাফা কমে আসবে।
এদিকে তীব্র সংকটের কারণে চলতি বছর ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে লাগামহীনভাবে বেড়েছে ডলারের দাম, কমেছে টাকার মান। বছরের প্রথম দিকে ডলার বাজার স্থিতিশীল থাকলেও মে মাস থেকে চরম অস্থিরতা বিরাজ করে। অস্থিরতা কিছুটা কমলেও সংকট এখনো প্রকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ দরের হিসাবে ৩৫ দশমিক ২০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। অন্যদিকে খোলা বাজারে ডলারের দামের হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩৭ শতাংশ।
একদিকে বাড়ছে না ব্যাংকের ঋণসীমা অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থে গঠিত ৭০০ কোটি ডলারের ইডিএফ থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি তা ৫০০ কোটি ডলারে নামিয়ে এনেছে। তহবিলের আকার কমিয়ে আনায় ব্যবসায়ীরা আপত্তি জানিয়েছেন। ইডিএফ থেকে মার্কিন ডলারে ঋণ দেওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সংকোচিত হয়ে গেছে। যেমন ইডিএফের আকার কমিয়ে আনা হয়েছে। ডলার সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। আগের চেয়ে ক্রয়াদেশ কমে আসছে। সব কিছুতে একটি নেতিবাচক প্রবণতা চলছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংক ঋণের সীমা বাড়াচ্ছে না। বিশ্ব একটি খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাটাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনাকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে টিকিয়ে রেখেছে তা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
গত বছরের ৩১ মার্চ চলতি মূলধন ঋণসীমা অন্তত ৪০ শতাংশ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। পরে ঐ বছরের ২৭ এপ্রিল চলতি মূলধন ঋণসীমা বাড়ানোর সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এ ঋণসীমা বাড়াতে পারবে জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাত্ কোনো গ্রাহকের চলতি মূলধন ঋণসীমা যেটা নির্ধারণ করা থাকে, চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো ঐ গ্রাহককে সীমার বেশি ঋণ দিতে পারবে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ায় এই পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বেশির ভাগ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা আমলে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে একাধিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা জানিয়েছেন, লিমিট না বাড়ানোর বিষয়টি সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে সঠিক নয়। কেউ বাড়াচ্ছে আবার কেউ বাড়াচ্ছে না। এটি দুটি কারণে হতে পারে। প্রথমত, যে সব ব্যাংকে পর্যাপ্ত মূলধন নেই বা নগদ টাকার সংকট রয়েছে তারা গ্রাহকের লিমিট বাড়াতে পারছে না।
দ্বিতীয়ত, কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) উদ্যোগে ডিবিএস নামে ২০২০ সালে একটি সফটওয়্যার চালু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যার মাধ্যমে এনবিআরের কর্মকর্তারা নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি জাল প্রতিবেদন শনাক্ত করতে পারে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণসীমা বাড়ানোর বিষয়টি নির্ভর করে ব্যাংক এবং গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। ব্যাংক যদি ঋনসীমা না বাড়ায় তাহলে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ঋণসীমা বাড়লে তা ব্যাংকেরই লাভ। বাড়তি ঋণ থেকে ব্যাংক বাড়তি কমিশনও পায়। তবে অনেক গ্রাহক ইতিমধ্যে তাদের ঋনসীমা বাড়িয়ে নিয়েছেন। যাদের দেওয়া হচ্ছে না তাদের হয়তো কোনো সমস্যা থাকতে পারে বা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকেরও আর্থিক সংকট থাকতে পারে।