আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশি গরুতেই কোরবানির চাহিদা মিটবে। সোয়া এক কোটি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ফলে উদ্বৃত্ত থাকতে পারে ১০ থেকে ১৫ লাখ গরু-ছাগল। বেপারীরা বলছেন, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তাই এবার ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি থাকবে। এ ছাড়াও কোরবানির সংখ্যা আগের চেয়ে কমতে পারে।
কোরবানির জন্য এবার গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৯টি গবাদিপশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩টি। ছাগল ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭, উট, দুম্বা ও অন্যান্য পশুর সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯টি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু কোরবানি হয়। যার মধ্যে গরু-মহিষ ছিল ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি এবং ছাগল-ভেড়া ছিল ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি। এ ছাড়াও অন্যান্য পশু জবাই হয় ৭১৫টি। মহামারি করোনার কারণে প্রায় ২৮ লাখ গবাদিপশু অবিক্রীত থাকে।
গাবতলীর গরুর বেপারী জসিম উদ্দিন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবার পাবনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মেহেরপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও যশোর অঞ্চল থেকে ঢাকায় প্রচুর গরু আসবে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে দেশের স্থানীয় হাট বাজারে গরু আসলেও ক্রেতার দেখা মিলছে না। বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে গাবতলী হাটে গরুর ট্রাক আসছে। দাম এখনো ক্ষয়ক্ষমতার মধ্যে আছে। চাকরি হারিয়ে অনেকে বেকার হয়ে আছেন, ব্যবসায় লোকসান গুনেছেন কেউ কেউ। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। সে কারণে কোরবানির সংখ্যা এবার কমবে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ গরু-ছাগল অবিক্রীত থাকবে।
প্রানিসম্পদ অধিপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি বন্যায় দেশের বিভিন্ন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অনেকে নতুন করে পুঁজি হারিয়েছেন। অনেকে ঘরবাড়িসহ সর্বস্ব হারিয়ে বেড়িবাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এবার কোরবানি দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন। অনেকের কোরবানির সামর্থ্য নেই। তারা আরও জানান, দেশের ১২টি জেলার ৭৪ উপজেলার ৩২৬ ইউনিয়নের ১৫ হাজার গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খামারিদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬১ কোটি ৮৩ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টাকা।
মানিকগঞ্জের গরুর খামারি আব্দুল হাই বলেন, কোরবানির ঈদের জন্য ৫২টি গরু লালন পালন করেছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরু লালনপালনে অনেক বেশি টাকা খরচ হয়েছে। আমার খামারে ৬শ’ কেজির একটি গরু আছে, যার দাম সাড়ে চার লাখ টাকায় বিক্রি না করতে পারলে আমার পুঁজি চলে যাবে। অন্যান্য ছোট ও মাঝারি মানের গরু দেড় লাখ বা তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি না হলে পথে বসতে হবে।
ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রতিবছর পশুর হাট বসে। সেই হিসেবে গরু, ছাগলের খামারিরা সারা বছর গরু-ছাগল লালন পালন করেন। আবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও তিন মাসে গরু-ছাগল মোটাতাজা করে কোরবানির হাটে তোলেন। যে বছরগুলোতে দেশের বাইরে থেকে গরু আসে, সে বছরগুলোতে গরু-ছাগলের ন্যায্যমূল্য পান না দেশের খামারিরা। তাই এবার বিদেশ থেকে গরু আমদানি না করার দাবি খামারিদের।
নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জের গরুর খামারি আরিফ হোসেন বলেন, নানা রকম ভুসি, সরিষার খৈল, খড় ও কাঁচা ঘাস খাইয়ে গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। ভুসির দাম এবার তিনগুণ বেড়েছে। সব মিলে গরুর খাবারের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গরু লালন-পালন করতে বড় বিনিয়োগ করতে হয়েছে। স্থানীয় বাজারে গরুর দাম কম। বাজারে গরু থাকলেও ক্রেতা নেই।
এদিকে গতবারের মতো এবারও বেসরকারি উদ্যোক্তার পাশাপাশি সরকারিভাবে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ঈদুল আজহা আসতে আরও সপ্তাহ দেড়েক বাকি থাকলেও অনলাইনে ক্রেতার উপস্থিতি কম বলে জানায় ঈদকাউডটকমের ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম নুপূর। তিনি বলেন, সীমান্ত পথে অন্যান্য বছরের মতো চোরাই পথে গরু আসলে দেশের খামারিরা বিনিয়োগ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
উলেস্নখ্য, ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক নির্দেশনার পর ভারত থেকে বাংলাদেশে কোরবানির গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞার বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি গরু চোরাই পথে আসত। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের নিষেধাজ্ঞার পর গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে মাত্র আড়াই শতাংশ সুদে গরু- ছাগল লালন-পালনে খামারিদের ঋণ প্রদান শুরু করে সরকার। এরপর দুই বছরে বাংলাদেশ গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, খামারিদের স্বার্থ বিবেচনা করে কোরবানির হাটে দেশের বাইরে থেকে একটি গরুও প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। খামারিরা মহামারি করোনার মধ্যে অনেক কষ্ট করে লাভের আশায় গরু-ছাগল লালন পালন করেছেন। তাদের গরু-ছাগল বিক্রি হবে না, বাইরে থেকে আসবে- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, দেশে পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। কোরবানির পর অনেক পশু অবিক্রীত থাকার আশংকা রয়েছে। তাই চোরাই বা অন্য কোনো পথে একটা পশুও যেন দেশে প্রবেশ করতে না পারে, বিষয়টি নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা সংস্থাকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।