ডলারের তুলনায় টাকার মান কমে যাওয়ার প্রভাব এবার বাজেটেও পড়ছে। বাড়তি সুদ পরিশোধে বাড়তি বরাদ্দ রাখতে হবে। চলতি অর্থবছর থেকেই এই চাপ তৈরি হয়েছে। আগামী অর্থবছরে এই চাপ আরো বাড়বে। আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই অর্থের মধ্যে সুদ ব্যয় বাবদই বরাদ্দ রাখতে হবে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ সুদ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। ডলারের তুলনায় টাকার মান কমে যাওয়ায় সুদের পরিমাণের ওপর প্রভাব পড়েছে, বিশেষ করে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে। অবশ্য সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াও এর একটি কারণ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাজেটে প্রস্তাবিত বরাদ্দের মধ্যে ঋণের সুদে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ।
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্য, গ্যাস ও সারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি সংকট সৃষ্টি হয় মার্কিন ডলারের। যে কারণে টাকার বিপরীতে বেড়ে যায় ডলারের দাম। ডলার ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আমদানি ব্যয়কে বাড়িয়ে দেয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার ও খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যায়। অপরদিকে সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ভর্তুকিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। অর্থ বিভাগের হিসাবে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরে শুধু কৃষি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যে অতিরিক্ত ভর্তুকি গুনতে হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি ডলার মূল্যবৃদ্ধিসহ অতিরিক্ত অভ্যন্তীরণ ঋণের সুদ পরিশোধে বাড়তি ব্যয় হবে ৯ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায় বাড়নো, বাজেট বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ গণ।
আগামীতে ছয়টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়নের কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, প্রথমত, রাজস্বের কর-জিডিপির আনুপাতিক হার বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত. মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তার দিকে নজর দিতে হবে। তৃতীয়ত. সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এটি যেন সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত. ডলার সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে রিজার্ভ কীভাবে আরো বাড়ানো যায় সে পদক্ষেপ নিতে হবে। পঞ্চমত. রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ষষ্ঠত. রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য নতুন বাজার তৈরি করা এবং দক্ষলোক সৃষ্টি করতে হবে। যাতে তারা আরো বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন সে দিকে বাজেটে খেয়াল রাখতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্য, কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খাদ্যে ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, বিদ্যুতে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং কৃষিতে ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই তিন খাতের ভর্তুকিতে আরো ব্যয় হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। তাহলে এসব খাতে মোট ভর্তুকি দাঁড়াবে ৬০ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এ বছরই আরো ৯ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে সুদ ব্যয়ে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই ব্যয়ের বড় অংশ যাবে অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয়ে। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে আসায় এই খাতে আগামী অর্থবছর চাপ কম থাকবে।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, সঞ্চয়পত্র ছাড়া সব ধরনের ঋণ বৃদ্ধির কারণে আগামী অর্থবছরে এ সব খাতে সুদ ব্যয় বাড়বে। এমনকি আগামী অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়ও বাড়বে। আর নতুন সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হলেও আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সুদ ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গত ছয়টি অর্থবছরের বাজেটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুদ ব্যয় ছিল ৪৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। পরে এই ব্যয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৭ হাজার ৬৬৪ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ হাজার ৬০৬ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭১ হাজার ২৪৪ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।