পুলিশ সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের মনোভাব খুব একটা ইতিবাচক নয়। এটা প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। আমাদের সাহিত্যে, স্মৃতিকথায় তো অনাস্থার চিত্রই ছড়িয়ে রয়েছে নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু করা যাক। কলকাতার এক পুলিশ কর্মকর্তা পঞ্চানন ঘোষাল তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, লেখক হিসেবে তিনি একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। পঞ্চাননবাবুর পুলিশ পরিচয় শুনে রবীন্দ্রনাথ তাকে অপরাধ জগত্ নিয়ে লিখতে বলেন এবং সেই সঙ্গে পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘পুলিশ যদি কারোর পা-ও জড়িয়ে ধরে তো লোকে মনে করে যে পুলিশ তার জুতো জোড়াটা সরাবার মতলব করছে।’ রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাননবাবুকে ‘লোকের মনে করার কথা’ বলেছেন। নিজের মনেও কিন্তু পুলিশ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল না। যে কারণে তার লেখা উপন্যাস ‘গোরা’তে গরিব সন্তানের পক্ষে পিতামাতার শ্রাদ্ধ করাটা কতটা কঠিন সে প্রসঙ্গে উপমা দিতে গিয়ে টেনে আনেন পুলিশকে। এবং তাদের বিদ্ধও করেন কঠোরভাবে। লেখেন, ‘যেমন ডাকাতির অপেক্ষা পুলিশ-তদন্ত গ্রামের পক্ষে গুরুতর দুর্ঘটনা, তেমনি মা-বাপের মৃত্যুর অপেক্ষা মা-বাপের শ্রাদ্ধ করাটা দুর্ভাগ্যের কারণ হইয়া উঠে।’
পুলিশ থেকে নায়ক হওয়া ধীরাজ ভট্টাচার্য তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘পুলিশের নাম শুনলেই লোকে ঘৃণায় ভ্রু কুঁচকে প্রকাশ্যে গালাগাল দিতে শুরু করে।’ আর পঞ্চানন ঘোষাল শুনিয়েছেন তার এ রকমই এক অভিজ্ঞতার কথা। একবার ট্রেনে আসার সময় একটি পরিবারের সঙ্গে পঞ্চাননবাবুর ঘনিষ্ঠতা হয়। পরিবারের কর্তাটি তার বালিগঞ্জের বাড়িতে পঞ্চাননবাবুকে একবার পায়ের ধুলো দিতে বলেন। এর পরে হাওড়া স্টেশনে নামার পরে ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল। কিন্তু মশাই কী করেন তা জানা হল না।’ পঞ্চাননবাবু নিজের পরিচয় দিলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন, ‘সে কী, আপনি পুলিশ অফিসার! আমি তো ভেবেছিলাম ভদ্রলোক।’ আমাদের সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে পুলিশের নানা অত্যাচার অসততার কথা। ভুবনমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’র দারোগা খড়গরামের কথাই ধরা যাক। পদ্মনগরের কেষ্টহরি ভট্টাচার্যের একমাত্র ছেলে সর্পদষ্ট হয়ে মারা গিয়েছে শুনে দারোগা খড়গরাম দলবল নিয়ে ওখানে হাজির হয়ে বলে, ‘তোদের ঘরে সাপ ছিল, তাকে তাড়াসনি, থানাতেও খবর দিসনি, ইচ্ছে করে সাপ দিয়ে কাটিয়ে ছেলেকে খুন করেছিস, ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য লাশ চালান দিতে হবে। তোকে আর তোর বউকেও ছাড়ব না।’ দারোগার মুখে এমন কথা শুনে কেষ্টহরি তো তাজ্জব! এমন অভিযোগের আসল উদ্দেশ্যটি কেষ্টহরি বোঝেন একটু পরেই। এক যজমানের কাছে থেকে পাঁচটি টাকা ভিক্ষে করে নিয়ে খক্ষরামকে দেন এবং ছেলের মৃতদেহ সত্কারের অনুমতি লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। দারোগা ললিত চক্রবর্তী এ গল্পে পাড়াগেঁয়ে নেটিভ ডাক্তারটিকে ভিটেছাড়া করে। অপরাধ? সে দারোগার মুখের ওপর তার অমানবিক আচরণ দেখে বলেছিল, ‘আপনি মানুষ, না পিশাচ?’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মুক্তি’ গল্পের তুলসী দারোগা আবার আর এককাঠি সরেস। ছয়কে নয় করাতে ওস্তাদ এই দারোগার চরিত্রের দোষও বিলক্ষণ। সুন্দরী গ্রাম্যবধূ নিস্তারিণীর ওপর তার কুনজর পড়ে। বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’ উপন্যাসের দারোগা নীলকুঠীর নুন খেয়ে তাদের হয়েই কাজ করে। রামকানাই কবিরাজকে রামু বাগদি খুনের ঘটনায় মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ার জন্য দারোগা নীলকুঠির হয়ে চাপ দেয়। এবং সফল না হয়ে নীলকুঠির দেওয়ান রাজারামকে বলে যায়, ‘দেওয়ানজি, কবিরাজ বুড়ো বড় তেঁদড়। ওকে হাত করতে হবে। ডাবের জল খাওয়ান ভালো করে।’
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ উপন্যাসে মহাদেব দারোগার সঙ্গেও অনেক বাঙালি পাঠকের পরিচয় আছে। রজনীর বাবা হরেকৃষ্ণ দাস বাড়িতে একাকী মারা গেলে মহাদেব দারোগা দলবল নিয়ে এসে হরেকৃষ্ণ দাসের ঘরের সবকিছু হস্তগত করে। মৃত্যুকালে হরেকৃষ্ণ গোবিন্দকান্ত দত্তের কাছে কিছু অলংকার রেখে গিয়েছিলেন। মহাদেব দারোগা সে খবর জানতে পেরে তাকে ডাকিয়ে এনে সেগুলোও করায়ত্ত করেন। হরেকৃষ্ণ দাসের কন্যা রয়েছে—এ খবরকে মহাদেব পাত্তা না দিয়ে অলংকারগুলো নিজের মেয়ের ব্যবহারের জন্য পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে।
সাহিত্যে পুলিশের এমন চরিত্রচিত্রণ নিশ্চয়ই বানানো নয়। হুতোম অনেক আগেই তার নকশায় লিখেছেন, ‘পুলিশের সার্জন-দারোগা-জমাদার প্রভৃতি গরিবের যমেরা থানায় ফিরে যাচ্ছেন; সকলেরই সিকি, আধুলি পয়সা ও টাকায় ট্যাঁক ও পকেট পরিপূর্ণ।’ এ তো ঘুষের গল্প। আর অত্যাচার? একটি প্রাচীন বাংলা পত্রিকা খোলাখুলি লেখে, ‘এই সংসারে যত প্রকার অত্যাচার আছে, তন্মধ্যে বঙ্গীয় পুলিশের অত্যাচারই সর্বাপেক্ষা কঠোর, নিষ্ঠুর ও নৃশংস।’
কম বেতন এবং এদেশীয়দের জন্য পদোন্নতির কম সুযোগ স্বাধীনতার আগে ভদ্র ও শিক্ষিত যুবকদের পুলিশের চাকরিতে খুব একটা প্রলোভিত করত না। ফলে শিক্ষাদীক্ষাহীন সুযোগসন্ধানী মানুষেরাই এই চাকরিতে ঢুকতেন। কিন্তু এখন অবস্থা পালটেছে। অন্য আর পাঁচটা সরকারি চাকরির মতো পুলিশের চাকরিও লোভনীয় ও দুর্লভ। শিক্ষিত ভদ্রজনদের পুলিশের চাকরি নিয়ে নাক সিটকানোর দিন আর নেই। কিন্তু তাদের অবাধ প্রবেশ সত্ত্বেও পুলিশদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা তেমন উজ্জ্বল হয়নি। তাই ‘বকুল’ (নজরুল ইসলাম)-এর মতো সামান্য কিছু জায়গা ছাড়া, স্বাধীনতার পরের গল্প-উপন্যাসেও সেই একই পুলিশি অত্যাচারের গল্প এবং তাদের প্রতি মানুষের সেই চিরাচরিত অনাস্থারই কথা। এর জন্য কিছুটা দায়ী পুলিশের কাজের ধরনটাও।
এ প্রসঙ্গে ‘পথের দাবী’র নিমাইবাবুর সেই কথাটা আজও প্রাসঙ্গিক। ‘বাইরে থেকে তোরা পুলিশকে যত মন্দ মনে করিস সবাই তা নয়, কিন্তু মুখ বুজে যত দুঃখ আমাদের পোহাতে হয় তা যদি জানতে তো তোমার এই দারোগা কাকাবাবুটিকে অত ঘৃণা করতে পারতে না অপূর্ব।’
আসলে রাজা বদল হয়, কিন্তু বদলায় না শাসনের রীতি ও পথ। তাই আজও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মুখ বুজে সব সয়ে যেতে হয় আর রাগে বেদনায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মহানন্দা’ উপন্যাসের দারোগা মফিজর রহমানের মতো বলতে হয়, ‘পুলিশের চাকরি, এমন পাজি কাজ ভূ-ভারতে আর নেই।’
তবে আমাদের দেশে পুলিশ সম্পর্কে ‘অতিকথন’ বেশি। একদিন এক দারোগা সাহেবের পকেট থেকে তার স্ত্রী ১০০ টাকা ‘চুরি’ করেন। সবাই জানে, স্বামীর পকেট থেকে টাকা সরানোর নাম চুরি নয়। যাহোক, দারোগা সাহেব সঙ্গে সঙ্গে খপ করে স্ত্রীর হাত ধরে বলেন, আজ তোমাকে ছাড়ব না। আমি পুলিশের লোক। তোমাকে লালঘরে ঢোকাবই। স্ত্রী তার শাড়ির খুঁট থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে স্বামীর হাতে দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার দক্ষিণা। হাতটা এবার ছেড়ে দাও। কথা আর বাড়িয়ো না। বাড়ির বাইরে ঘুষ খাওয়া নিয়ে কোনো কোনো পুলিশের বদনাম আছে। দুই-চার জন দুর্নীতিপরায়ণের জন্য একটা বিভাগের সবাইকে দায়ী করা যায় না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘হকল মাছে ময়লা খায়, আর লাড়িয়ার উপরে দোষ যায়’। ঘুষ নেওয়ার জন্য শুধু পুলিশকে কেন দোষারোপ করা হবে? অন্যান্য অনেক বিভাগের কর্মচারীও ঘুষ নেন। ওপরতলার অনেক রাঘববোয়ালও ঘুষ খান। কিন্তু দোষ হয় পুলিশের! আসলে বদনাম হজম করাই বুঝি আমাদের দেশের পুলিশের নিয়তি!
পরিশেষে পুলিশ নিয়ে একটি ভিনদেশি গল্প। আইফেল টাওয়ারের অদূরে এক সুন্দরী নারী পর্যটক হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তাকে অনুসরণ করছেন স্থানীয় এক যুবক। উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটি এগিয়ে গেলেন পুলিশের কাছে। বললেন, ‘ঐ লম্বামতন লোকটা আমার পিছু ছাড়ছে না। আমি যেখানে যাচ্ছি, সেও যাচ্ছে আমার পিছু পিছু। আমি খুবই বিরক্ত বোধ করছি।’
পুলিশ ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে বলল, ‘ডিউটিতে না থাকলে আমিও একই কাজ করতাম!’