গতকাল শনিবার অভিষেকের মধ্য দিয়ে রাজা তৃতীয় চার্লস হলেন ব্রিটেনের ৪০তম রাজা। লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে সীমিত, কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই রাজকীয় অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। তার মা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত বছর সেপ্টেম্বরে মারা যাওয়ার পর তিনি রাজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিটিশ রাজার কাজ কী এবং রাজপরিবার কতটা জনপ্রিয়। রাজা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান। তবে তার ক্ষমতা প্রতীকী এবং আনুষ্ঠানিক। তিনি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
প্রতিদিন ব্রিটিশ সরকারের কাজের রিপোর্ট তার কাছে লাল রঙের চামড়ার একটি বাক্সে করে পাঠানো হয়, যার মধ্যে থাকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বৈঠকের আগে সে সম্পর্কে ব্রিফিং, অথবা কাগজপত্র যাতে তার স্বাক্ষর করা প্রয়োজন। সাধারণত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রতি বুধবার বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করে তার সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে রাজাকে অবহিত করেন। এসব বৈঠক একান্ত ব্যক্তিগত এবং সেখানে যেসব কথাবার্তা হয় সেগুলোর আনুষ্ঠানিক কোনো রেকর্ড রাখা হয় না। এছাড়াও রাজার আনুষ্ঠানিক সংসদীয় কিছু ভূমিকা রয়েছে।
সাধারণ নির্বাচনে যে দল জয়ী হয় তার প্রধানকে সরকার গঠনের জন্য বাকিংহাম প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজা সংসদীয় বছর শুরু করেন। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় স্টেট ওপেনিং। হাউজ অব লর্ডসের একটি সিংহাসনে বসে রাজা ভাষণ দেন—যাতে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। যখনই পার্লামেন্টে কোনো বিল পাশ হয় সেটিকে আইনে পরিণত করার জন্য রাজাকে সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করতে হয়। শেষ যে বছর এরকম রাজকীয় অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়, সেটি ছিল ১৭০৮ সালের ঘটনা। এছাড়াও প্রত্যেক বছরের নভেম্বর মাসে রাজা বার্ষিক স্মরণ বা রিমেমব্রান্স অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এটি অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনের সেনোটাফ বা জাতীয় স্মৃতি স্তম্ভে। বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব রাষ্ট্রপ্রধান ব্রিটেন সফরে আসেন, রাজা তাদের নিমন্ত্রণ জানান। এছাড়াও ব্রিটেনে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদেরও সঙ্গেও তিনি নিয়মিত সাক্ষাত্ করে থাকেন। রাজা তৃতীয় চার্লস তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে জার্মানি যান যেখানে তিনি পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। তিনিই প্রথম ব্রিটিশ রাজা যিনি জার্মান পার্লামেন্টে ভাষণ দিলেন।
ব্রিটিশ রাজা কমনওয়েলথেরও প্রধান। ৫৬টি স্বাধীন দেশ নিয়ে এটি গঠিত এবং এই কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৫০ কোটি। ব্রিটেনের রাজা এই কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যে ১৪টির রাষ্ট্রপ্রধান। এছাড়াও রাজ পরিবারের সঙ্গে যে ৯০টি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক রয়েছে সেগুলোকেও তিনি সমর্থন দিয়ে থাকেন। এসব দাতব্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এবং যারা ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা ইত্যাদি।
ব্রিটিশ সিংহাসনে উত্তরাধিকারের ক্রমতালিকায় বলা হয়েছে, বর্তমান রাজার মৃত্যু হলে কিংবা তিনি সিংহাসন ছেড়ে দিলে রাজ পরিবারের কোনো সদস্য পরবর্তী সময়ে রাজা বা রানি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এই তালিকায় প্রথমেই যিনি রয়েছেন, তিনি রাজার প্রথম সন্তান। রাজকীয় এই উত্তরাধিকারের নিয়ম ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়, যার ফলে সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে পুত্ররা তাদের বড় বোনদের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবেন না। রাজা তৃতীয় চার্লসের পর যিনি রাজা হওয়ার তালিকায় সবার শীর্ষে রয়েছেন, তিনি প্রিন্স অব ওয়েলস প্রিন্স উইলিয়াম। এই তালিকার দুই নম্বরে রয়েছেন উইলিয়ামের বড় সন্তান প্রিন্স জর্জ। তিন নম্বরে তার কন্যা প্রিন্সেস শার্লোট। চার নম্বরে প্রিন্স লুইস এবং প্রিন্স হ্যারির অবস্থান পঞ্চম। রাজা তৃতীয় চার্লস এবং কুইন কনসর্ট ক্যামিলা বাকিংহাম প্রাসাদে বাস করেন। এর আগে তারা লন্ডনের ক্ল্যারেন্স হাউজ এবং গ্লস্টারশায়ারের হাইগ্রোভে সময় ভাগাভাগি করে থাকতেন। রাজ-পরিবারের অন্যান্য বাসভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে উইন্ডসর ক্যাসল, নরফোকের স্যানড্রিংহাম, এডিনবরায় প্যালেস অব হলিরুডহাউজ এবং অ্যাবার্ডিনশায়ারের ব্যালমোরাল ক্যাসল।
এদিকে রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেকের আগে রাজপরিবার সম্পর্কে জনগণের মনোভাব জানতে একটি জনমত সমীক্ষা পরিচালিত হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে বেশির ভাগ মানুষ রাজতন্ত্র অব্যাহত রাখার পক্ষে। তাদের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ। আর ২৬ শতাংশ চায় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করা হোক। রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটেনের বিভিন্ন বয়েসের লোকজনের মনোভাব একেক রকমের। তাদের প্রতি বয়স্ক লোকজনের সমর্থন বেশি। তরুণ প্রজন্মের কাছে রাজপরিবারের আবেদন তুলনামূলকভাবে কম। জরিপে অংশগ্রহণকারী যাদের বয়স ৬৫-এর ওপরে তাদের ৭৮ শতাংশ রাজা-রানির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৪, রাজপরিবারের প্রতি তাদের সমর্থন সবচেয়ে কম, মাত্র ৩২ শতাংশ। কিন্তু এই গ্রুপের ৩৮ শতাংশ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণ করার পক্ষে। বাকি ৩০ শতাংশ বলেছে, এ বিষয়ে তারা কিছু জানে না।
লন্ডনে রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ
এদিকে রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে লন্ডনে। গতকাল শনিবার সকালে ‘নট মাই কিং’ প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নামেন বিক্ষোভকারীরা। এসময় বিক্ষোভ থেকে তাদের বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়। ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ান জানিয়েছে, গ্রেফতারদের মধ্যে ‘রিপাবলিক’ ক্যাম্পেইনের প্রধান নির্বাহী গ্রাহাম স্মিথও রয়েছেন। ট্রাফালগার স্কয়ারে বিক্ষোভের মূল জায়গায় অন্য বিক্ষোভকারীদের জন্য পানীয় ও প্ল্যাকার্ড সংগ্রহ করার সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে এর আগে বলা হয়, তারা রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, যদি না বিক্ষোভকারীরা বিদ্যমান আইন ভঙ্গ করে গুরুতর ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। কিন্তু শনিবার ‘রিপাবলিক’ গ্রুপ টুইটারে জানায়, সকালে গ্রাহাম স্মিথ ও আমাদের টিমের পাঁচ জন গ্রেফতার হয়েছেন। শত শত প্ল্যাকার্ড জব্দ করা হয়েছে। এটা কী গণতন্ত্র?
ব্রিটিশ সংবাদপত্র ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে, ট্রাফালগার স্কয়ার থেকে প্রজাতন্ত্র আন্দোলনের নেতা স্মিথকে গ্রেফতার করা হয়। সেখানে মিছিল করার জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছ থেকে অনুমতি চেয়েছিলেন রিপাবলিকের সমর্থকেরা। গ্রেফতারের এই ঘটনায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা বলছে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক আইনে ‘স্পষ্টভাবে সুরক্ষিত’। বিষয়টি নিয়ে মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন মুখপাত্র জানান, উৎপাত সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করার সন্দেহে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বিক্ষোভে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো জব্দ করা হয়েছে।