আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখেও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যারা দ্রুত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে সামনে বাংলাদেশের জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছে আইএমএফ। চ্যালেঞ্জ তিনটি হলো—ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি। আইএমএফ মনে করছে, এসব কারণে দেশের প্রবৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রার মজুত ও স্থানীয় মুদ্রা টাকার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে। আইএমএফের স্টাফ পর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করেছে। সেই সফরের পরিসমাপ্তিতে বাংলাদেশ মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দ বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন।
এদিকে, গতকাল শেষ দিনে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার পর সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী মুদ্রানীতিতে ইন্টারেস্ট রেট করিডর বা বাজারভিত্তিক সুদহার চালুর বিষয়ে ঘোষণা দেবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক। একই সঙ্গে মুদ্রার একক বিনিময় হার চালুর দিকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
একক বিনিময় হার চালুর বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মেজবাউল হক বলেন, মুদ্রার একক বিনিময় হার মানে এই নয় যে, ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের হার একই হবে। এখন একাধিক বিনিময় হার আছে, তবে সেগুলোর মধ্যকার ব্যবধান ২ শতাংশের মধ্যে এলেই বলা যাবে, মুদ্রার একক বিনিময় হার আছে। সেটা প্রায় অর্জিত হয়ে গেছে। তবে তা আরো বেশি সীমার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হবে।
এ ছাড়া আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) অনুযায়ী রিজার্ভ গণনার বিষয়েও আগামী মুদ্রানীতিতে ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র। আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল আগামী অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে আসবে। বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের শর্তানুযায়ী, যেসব সংস্কার কার্যক্রম চালানোর কথা, সেগুলোর কিছু বিষয় সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্জিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ কী বলেছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মেজবাউল হক বলেন, আমরা জানি, আইএমএফ এসব যৌথ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে সন্তুষ্ট, যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সময় আছে, সেগুলো আমলে নিয়ে আমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করতে পারব।
চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মেজবাউল হক বলেন, সেটা তো আপনারা জানেন, রিজার্ভ গণনা নিয়ে একটা ইস্যু আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হিসাব করে, আইএমএফ তাতে পরিবর্তন চায়। তাদের পরামর্শ হলো, প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হোক।
মেজবাউল হক আরো বলেন, চলমান সফরে প্রধানমন্ত্রী যেসব দেশে গেছেন, তারা সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সেগুলো আসতে শুরু করলে দেশের ‘ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট’ আরো শক্তিশালী হবে। অনুমোদন করা ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ আইএমএফ এরই মধ্যে ছাড় করেছে। সংস্থার সদ্য সমাপ্ত মিশনের বা প্রতিনিধিদলের সফরের সঙ্গে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ প্রাপ্তির সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন মেজবাউল হক।
আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছে, তার শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুলাইয়ের মধ্যে একটি সুদহার করিডর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সুদহার করিডর এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারে পরিচালনভিত্তিক পরিবর্তন করা যায়।
গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভার পরে বলা হয়েছিল, ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারণ হবে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে। ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ পর্যন্ত যোগ করা যাবে।
তবে ব্যাংকঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার কত হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা প্রতি মাসে নির্ধারণ করে ঘোষণা করবে। এ হার ঠিক করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নির্ধারিত সূত্র অনুসরণ করবে। নতুন এ ব্যবস্থা কার্যকর হবে আগামী জুলাই মাস থেকে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘শর্টটার্ম মান্থলি এভারেজ রেট’ বা স্মার্ট। তবে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। পাশাপাশি ভোক্তা ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার কত হবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইএমএফের কর্মসূচি চালু থাকার কথা রয়েছে।
আইএমএফের সব শর্ত মানতে হবে এমন নয় : পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী
এদিকে গতকাল রবিবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আইএমএফ যে কোনো শর্ত দিলেই আমরা যে মেনে নেব তা কিন্তু নয়। তারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। আমাদের নিজের প্রয়োজনেই কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। হোক আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ সেসব শর্তই মানবে যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো।
তিনি বলেন, সুদ হার আপাতত বাড়ানো ঠিক হবে না। আমেরিকা যদিও সুদ হার বড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধীর যেতে হবে। সেটি একইভাবে কাজ নাও করতে পারে। বাংলাদেশকে নিজস্ব নীতিতে চলতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।