থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। এই রোগটির নাম এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Thalassa’ থেকে—যার অর্থ ‘সমুদ্র’। কারণ এই রোগের লক্ষণগুলো ভূমধ্যসাগরের পাড়ের অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম জানা গিয়েছিল। আর এ কারণে এটি ভূমধ্যসাগরীয় রক্তশূন্যতা নামেও পরিচিত। চিকিৎসক থমাম কুলি ১৯২৫ সালে এই রোগটির কথা বর্ণনা করেন। তিনি ইতালির শিশুদের মধ্যে গুরুতর রক্তস্বল্পতা, দুর্বল দৈহিক বৃদ্ধি, বৃহৎ পেটের গড়ন ও শিশুর অকালমৃত্যু লক্ষ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ সালে, রক্তের হিমোগ্লোবিনের (রক্তের লোহিতকণিকা) উৎপাদন ত্রুটির কারণে থ্যালাসেমিয়া রোগটি হয় বলে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন। থ্যালাসেমিয়া সংক্রামক ব্যাধি নয়। বাবা ও মায়ের কাছ থেকে এটি সন্তানের কাছে পৌঁছে। যদিও রোগটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রথম জানা গিয়েছিল; কিন্তু রোগটি ইতালি, গ্রিক, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা বংশোদ্ভূত মানুষের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই ধরনের। হিমোগ্লোবিনের আলফা এবং বিটা অংশ বা প্রোটিন তৈরির ওপর ভিত্তি করে থ্যালাসেমিয়ার নামকরণ করা হয়েছে। হিমোগ্লোবিনে আলফা প্রোটিন অনুপস্থিত থাকলে তাকে আলফা—আর যদি বিটা প্রোটিন অনুপস্থিত থাকে তাকে বিটা-থ্যালাসেমিয়া বলা হয়। এই দুটি অংশ হিমোগ্লোবিনের বিল্ডিং ব্লক হিসেবে কাজ করে। তাই পর্যাপ্ত বিল্ডিং ব্লক না পেলে স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না। গ্লোবিন জিনের (আলফা ও বিটা) পরিব্যক্তি বা পরিবর্তন (মিউটেশান) থ্যালাসেমিয়া রোগের তীব্রতার মাত্রা প্রভাবিত করে।
প্রায় বিশ্বের জনসংখ্যার ৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের আলফা বা বিটা অংশের রূপান্তর রয়েছে। সবার মধ্যে এর লক্ষণ দেখা যায় না। অনেকে নীরব বাহক হিসেবে কাজ করে। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিশ্বে ১০ কোটি মানুষ বিটা-থ্যালাসেমিয়ার বাহক, যাদের মধ্যে ১০ লাখ শিশু। বাংলাদেশের ১ থেকে প্রায় ২ কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে ৩৬ লাখ মানুষ বিটা-থ্যালাসেমিয়া বহন করছে এবং ৪৮ লাখ মানুষ মৃদু লক্ষণের বিটা-থ্যালাসেমিয়া বহন করছে। দেশে প্রতি বছর ৭ হাজারেও বেশি শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
যদিও বাংলাদেশ বিশ্বের থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত দেশগুলোর অন্যতম; কিন্তু এই রোগটি নিয়ে তেমন গবেষণা, রোগ নির্ণয় কিংবা সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ তুলনামূলক কম। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষের উচ্চ মাত্রার রক্তশূন্যতার একমাত্র কারণ আয়রন স্বল্পতা নয়। দেশব্যাপী রক্তশূন্যতার যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় পাঁচ বছরের নিচে ৩৩ শতাংশ শিশু এবং ২৬ শতাংশ নারী রক্তশূন্যতায় ভুগছে। এই সংখ্যাটি আয়রন স্বল্পতার কারণে রক্তশূন্যতায় ভোগা মানুষের সংখ্যার তিন গুণ। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রক্তশূন্যতার অন্যান্য কারণগুলোও খতিয়ে দেখা আবশ্যক। সম্প্রতি একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, রক্ত পরীক্ষা করা দেশে ২৮ শতাংশই গ্রামীণ নারীদের বিটা-থ্যালাসেমিয়া বা হিমোগ্লোবিন-ই রয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত দেশে মারাত্মকভাবে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত পাঁচ বছরেরে নিচে মৃত্যুবরণ করে এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের গড় আয়ুষ্কাল প্রায় ৩০ বছর হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়ে শিশুমৃত্যুর হার ১৯৯০ সালের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়ে এনেছে। কিন্তু বংশগত রোগগুলো ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে তেমন কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার ব্যাপকতা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বাড়ানোর ও মানুষের মধ্যে সঠিক তথ্য প্রবাহের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে বাহক বাছাই বা স্ক্রিনিং, বিবাহপূর্ব থ্যালাসেমিয়া বাছাই, পিতামাতার থেলাসেমিয়া নির্ণয়, জিনেটিং কাউন্সিলিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
থ্যালাসেমিয়া গবেষণা, ডায়াগনসিস যেমন পর্যাপ্ত মলিকুলার ডায়াগনস্টিক ল্যাব নির্মাণসহ ও এর ওপর উচ্চতর শিক্ষা প্রসারের নিমিত্তে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। এ বছর আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবস পালিত হচ্ছে তিনটি মূল প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে—‘সচেতন হোন, অন্যের সঙ্গে অংশীদার হোন, এবং যত্ন নিন’ (Be Aware. Care. Share)। আসুন, আমরা শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার গুণগত যত্ন নিতে অগ্রসর হই, আর যারা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে বসবাস করছে এবং যারা তাদের স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের গুণগত থ্যালাসেমিয়া শিক্ষা প্রসারে মনোযোগী হই।