বাংলা ভাষায় যেসব গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধের বই বের হয় তার পাঠক কারা? কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের শতকরা দশ ভাগ পুরুষ নিয়মিত বই পড়েন কি না সন্দেহ আছে। আগে যখন পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার থাকত তখন বইপড়ার চল কিছুটা ছিল। আগে দশ টাকা দিয়ে যত ইচ্ছে পড়ার সুযোগ পাওয়া যেত। কিন্তু সেই পাঠকের সংখ্যা সীমিত ছিল। যখন পাঠাগার উঠে গেল তখন টাকা খরচ করে বই কেনার পুরুষ-পাঠক হুহু করে কমে যেতে লাগল। তিন কোটি মানুষের মধ্যে দুই হাজার বই বিক্রি কোনো ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। পাঠাগার যখন ছিল তখন বইয়ের চাহিদা ছিল পাঠিকাদের কাছ থেকে। মধ্যাহ্নভোজনের পর বই বুকে নিয়ে শুয়ে অনেকে চমত্কার ঘুমাতে পারতেন। তবু তার মধ্যেই কেউ কেউ সিরিয়াস পাঠিকা হয়ে উঠেছিলেন। এদের অনেকেই পরে টাকা দিয়ে বই কিনে পড়ছেন। বইমেলায় বই এদের সৌজন্যেই বিক্রি হয়। মূলত উপন্যাসের পাঠিকা এরা। কিছু তরুণ-তরুণী কবিতার ভক্ত। তারা শক্তি-সুনীল থেকে শামসুর রাহমানের কবিতা মুখস্থ বলতে পারেন। কিন্তু কবিতার বই, রবীন্দ্রনাথ-পরবর্তী কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ছাড়া আর কারো বিপুল বিক্রি হয় না। কাজী নজরুল ইসলামের সঞ্চিতার বিক্রি খুব ভালো ছিল এককালে। কবিতা লিখে নাম করার পরেও শক্তি চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেছেন, ‘উপন্যাস টাকা দেয়, কবিতা দেয় না।’ প্রাবন্ধিকদের চাহিদা কম। তাদের বিষয় আকৃষ্ট করলে বুদ্ধিজীবীরা কিনে থাকেন। তবে পশ্চিমবাংলার বুদ্ধিজীবীরা এই রকম বই পকেটের টাকায় কেনার চেয়ে উপহার পেতেই পছন্দ করেন।
মোদ্দা কথা হলো পশ্চিমবাংলায় বই বিক্রির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। একটি বই অন্তত আট শ কপি বিক্রি হলে প্রকাশকের খরচ ওঠে। পরিচিত নামের অনেক লেখকের বই বিক্রি গোটা বছরে ঐ সংখ্যায় পৌঁছায় না। এখন মাত্র পাঁচ-ছয় জন লেখকের উপন্যাস বছরে তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়। এদের নতুন বই পেতেই প্রকাশকরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। যেসব শিক্ষিত পশ্চিমবঙ্গীয় সন্তান ভালো চাকরি করতে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন, তারা আবার বাংলা বইয়ের খবর রাখেন না। সমরেশ বসু এবং সমরেশ মজুমদারের পার্থক্য বোঝেন না। আমাকে অনেকবার শুনতে হয়েছে—‘বিবর’ বা ‘প্রজাপতি’ কেন লিখেছিলেন? এই যাদের বিদ্যে তাদের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।
হুমায়ূন আহমেদ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তার বই বিক্রির রেকর্ড তৈরি করেছিল। আমি বিশ্বাস করি, তার চলে যাওয়ার পরও বই বিক্রি কমে যায়নি। মেলায় প্রকাশিত উপন্যাস তিরিশ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে শুনে অবাক হয়েছিলাম।
হুমায়ূন হেসে বলেছিলেন, ‘এই বই তিন বছর পরে দশ কপিও বিক্রি হবে না। কিন্তু আপনাদের অনেকেরই বই বছরে কয়েক হাজার করে হলেও তিরিশ বছর ধরে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।’
ঠিকই। তবে সব বই নয়, কোনো কোনো বই। আমার গোটা সাতেক বইয়ের ভাগ্যে এটা হয়েছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর মতো বিনয়ী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
শুনেছি ওর পরে যারা উপন্যাস লিখছেন তাদের বই বিক্রি কলকাতার লেখকদের মতোই। মুহম্মদ জাফর ইকবাল অত্যন্ত জনপ্রিয়, হুমায়ূনের কাছাকাছি তার বইয়ের বিক্রি; কিন্তু তিনি অন্যধারার উপন্যাস লেখেন। বাংলাদেশে অনেক কবি, জানি না তাদের বই কী রকম বিক্রি হয়। শামসুর রাহমান, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ দুর্দান্ত কবি, নিশ্চয়ই তাদের পাঠক অনেক।
বাংলাদেশের এই পাঠকরা ছড়িয়ে আছেন বিশ্বময়। তাদের অনেকেই হয়তো বড় চাকরি করেন না, অনেকেই ট্যাক্সি চালান, স্টোর্সে কাজ করেন, রেস্টুরেন্ট বা গ্যাস স্টেশনের কর্মী। কিন্তু তাদের বাড়িতে বাংলা বই থাকবেই। হুমায়ূন, মিলন থেকে শুরু করে সৈয়দ শামসুল হক সাহেবের বই সেসব বাড়িতে দেখেছি। আমার বা সুনীলদার বইও তারা সংগ্রহ করেন। হয়তো সেসব বই পাইরেটেড, তবু অনিমেষ মাধবীলতা অথবা দীপাবলির কথা স্বচ্ছন্দে বলেন। সমরেশ মজুমদার যে সমরেশ বসুর পরবর্তী প্রজন্মের লেখক—এই তথ্য তারা জানেন।
শুধু নিউ ইয়র্ক অথবা শিকাগোতে নয়, মেলবোর্নে যে মেয়েটি আমার পরিচয় জেনে দুটো হাত ধরে কেঁদে বলেছিল, ‘আপনার দীপাবলি আমারে ফাইট করতে শিখাইছে’—তাকে ভুলব কী করে? সে দেশে যায়নি বহুকাল, কিন্তু বাংলা বই না পড়লে ঘুমাতে পারে না। বলেছিল, ‘বই পড়লে মনে হয় দেশে আছি।’
আমি জানি, কলকাতার নবীন প্রজন্ম আর ঢাকার নবীনরা প্রায় একই পথে চলেছে। এরা বাংলা বই পড়েন না। দুঃখিত হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখবে বাংলাদেশের মানুষ—যাঁরা দেশে আছেন অথবা দেশের বাইরে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন।
একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। ডিসেম্বরের মধ্যরাতে বিদেশ বিভুঁইয়ে যখন তাপমাত্রা মাইনাস দশ, তখন ট্যাক্সিতে ফেরার সময় ড্রাইভার জানালেন তার গাড়ির গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। দূরে একটা গ্যাস স্টেশন দেখতে পেয়ে এগিয়ে যেতেই তার নিওন আলো নিভে গেল। গাড়িও বন্ধ। দেখলাম সর্বাঙ্গ শীতবস্ত্রে মুড়ে একজন লোক দরজায় তালা দিয়ে দ্রুত হাঁটছেন। অনেক ডাকাডাকির পরেও তাকে ফেরানো যাচ্ছে না, তখন অজান্তে চিত্কার বেরিয়ে এলো—‘ও দাদা, দাদা!’ ভদ্রলোক দাঁড়ালেন। দেখলেন। এগিয়ে এলেন ট্যাক্সির পাশে। ড্রাইভার তাকে অনুরোধ করল তালা খুলে গ্যাস দিতে। ভদ্রলোক ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে দাদা বলল?’
ট্যাক্সির ভেতরের আলো জ্বেলে দিল ড্রাইভার। বললাম, ‘আমি ভাই।’
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক চ্যাঁচালেন, ‘আরে দাদা! আপনি? সমরেশ মজুমদার তো? ঠিক চিনেছি। আমি আনোয়ার। ফরিদপুরের লোক। এই স্টেশনে কাম করি। এই মিঞা, গাড়ি ব্যাক করো। বইয়ে ফটো দেখেছি, আজ দাদারে দেখলাম। কী সৌভাগ্য!
’সৌভাগ্যটা ওর চেয়ে আমার হাজার গুণ বেশি, তা আমি জানি।