‘এটা ভালো যে, দেশের মানুষ আমাদের ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থা বোঝে না। কারণ তারা যদি বোঝে, তবে আমি বিশ্বাস করি আগামীকাল সকালের আগেই বিপ্লব হবে।’ কথাটি বলেছিলেন হেনরি ফোর্ড। ব্যাংক হলো ঋণ লেনদেনের প্রতিষ্ঠান। যখন ব্যক্তি টাকা আমানত রাখে, তখন মূলত ব্যক্তি ব্যাংককে ঋণ দেয়। আবার ব্যক্তি যখন ব্যাংক থেকে টাকা নেয়, তখন ব্যাংক ব্যাক্তিকে ঋণ দেয়। আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে ব্যাবিলন শহরে বর্তমান ব্যাংক-ব্যবস্থার মতোই ঋণ লেনদেনের ব্যবস্থা চালু ছিল, যদিও প্রাচীন যুগের ব্যাংক সব দিক থেকে আমাদের আজকের বিশ্বের ব্যাংকগুলোর মতো ছিল না। আধুনিক ব্যাংক-ব্যবস্থার শুরু রেনেসাঁ যুগের ইউরোপে। এদিকে মানুষ যে নোট ব্যবহার করে, তা ছাপায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর এই টাকা বা মুদ্রা মানুষের হাতে প্রবেশ করে ঋণের মাধ্যমে। টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংককে সরাসরি ঋণ দেয় এবং একের পর এক ঋণের চক্র ধারাবাহিকভাবে চালাতে থাকে আর এভাবেই সমাজে সব সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার সরবরাহ থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে বাজারে টাকার পরিমাণ কমাতে-বাড়াতে পারে রেপোর মাধ্যমে, যেখানে রেপো হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেওয়ার একটা মাধ্যম। তাহলে এটা স্পষ্ট যে, একটা দেশের সরকার কিংবা মানুষ শুধু ব্যবহার করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার পায়। যার অর্থ, ব্যক্তির পকেটের টাকার মালিক ব্যক্তি নিজে নন, মালিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন আসল কথা এই যে, যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের বিনিময়ে ঋণ দেয় আর যেহেতু টাকা অন্য কেউ তৈরি করতে পারবে না, তাহলে এই ঋণও কখনো সুদে-আসলে ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে একটি অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ে বাণিজ্যিক বা বেসরকারি ব্যাংকগুলো টাকা উত্পাদনে বড় অবদান রাখে। এখানে টাকা উৎপাদন বলতে টাকা ছাপানোকে নয়, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ কত টাকা ঋণ দিতে পারবে তা বোঝায়। যেখানে ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সব ব্যাংক নতুন টাকা তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ডিপোজিট আছে ১০০ টাকা এখন এই ১০০ টাকাকেই এই ব্যাংক তথা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারবে যদি ধরে নিই যে মোট ঋণের বিপরীতে ৫% টাকা ডিপোজিট হিসেবে রাখতে হয়, যাকে রিজার্ভ রেশিও বলা হয়। তবে ব্যাংকগুলো কাগুজে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয় না, বরং ঋণগ্রহীতার অ্যাকাউন্টে অ্যামাউন্ট দেখিয়ে দেয়। যেহেতু বর্তমানে প্রায় সব লেনদেন বা কেনাকাটা চেকে বা কার্ডে হয়, তাই এই নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকগুলোর ঝামেলা পোহাতে হয় না। তবে যদি ঋণগ্রহীতারা টাকা তুলতে যান, সে ক্ষেত্রে ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে ক্যাশের অভাব পূরণ করে, যাকে কলমানি মার্কেট বলা হয়। যে দেশে ক্যাশ টাকার চাহিদা বেশি, সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকার তুলনায় প্রায় সাত গুণ টাকা তৈরি করে ব্যাংকব্যবস্থা। পৃথিবীর সব দেশেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা এমন, যা মূলত একটা প্রহসনমূলক ব্যবস্থা।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ দেয়, তার সঙ্গে সুদ যুক্ত থাকে। এখন কথা হলো, টাকা বা মুদ্রা তো সীমিত বা একটা থেকে আরেকটা গজায় না। তাহলে এই সীমিত টাকা ধার দিয়ে সঙ্গে অতিরিক্ত টাকা বা সুদ চাইলে সমাজে কেউ না কেউ অবশ্যই দেউলিয়া হবে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মাত্র ১১ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকের মোট সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ গুণ। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে যেখানে জিডিপির ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ ছিল ব্যাংকের সম্পত্তি, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশে, যার অর্থ সুদের জালে ফেলে ব্যাংক সাধারণ মানুষের সম্পদ আস্তে আস্তে নিজের করে নিচ্ছে। এভাবে একসময় হয়তো আমাদের সবার আয় থাকবে, কিন্তু সম্পদ সব হয়ে যাবে ব্যাংকের আর এটাই সুদের সর্বনাশা ফাঁদ। তাই হয়তো একজন বিশেষজ্ঞ বলে গেছেন, ‘মুদ্রাব্যবস্থার দায়িত্ব ব্যাংকারদের হাতে তুলে দেওয়া মাফিয়াদের হাতে আর্মি তুলে দেওয়ার সমান।’