একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই। চার সদস্যের পরিবারে আমার, স্ত্রীর ও আমাদের বড় সন্তানের ভিন্ন ভিন্ন কালারের টুথব্রাশ এক জায়গায়ই রাখা হয়। ছোট সন্তান একেবারেই ছোট বিধায় তার এখনো দাঁত ব্রাশ করার প্রয়োজন পড়ে না। যাহোক, সবাই যার-যার মতো নিজের টুথব্রাশ করে। তিন জনের ব্রাশ তিন রঙের—সবুজ, নীল ও বেগুনি। অর্থাত্ ভিন্ন ভিন্ন কালারের, যাতে একজনেরটার সঙ্গে আরেক জনেরটা মিশে না যায়। কিছুদিন বাদে লক্ষ করি, সন্তানের টুথব্রাশের ক্যাপ (প্লাস্টিক কভার) নেই, যা কেনার সময়ে প্রতিটি ব্রাশের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল! ছেলের ব্রাশে ময়লা, জীবাণুর সংক্রমণ বিবেচনায় আমার ব্রাশের ক্যাপ ওর ব্রাশে লাগিয়ে দিই। কর্মব্যস্ততার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে আর ভাবার ফুরসত পাইনি। মজার ব্যাপার হলো, দুই-এক দিন পর অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, আমার ব্রাশে ক্যাপ লাগানো; ছেলের ব্রাশে ক্যাপ নেই। বুঝলাম, ছেলে নিজেরটা খুলে আমারটায় লাগিয়ে দিয়েছে! আমি আবারও ক্যাপটা খুলে ছেলের ব্রাশে লাগিয়ে দিই। পরের দিন দেখি, আবারও ক্যাপ আমার ব্রাশে লাগানো; ছেলেরটা ফাঁকা! অর্থাত্, পৌনঃপুনিকভাবে বাবা ও ছেলের মধ্যে একে অপরের প্রতি খেয়ালের অংশ হিসেবে টুথব্রাশের ক্যাপ বদলাবদলি হতে থাকে। পিতা-সন্তানের পরস্পরের প্রতি এই ‘খেয়াল, যত্ন’ পিতা হিসেবে যতটা না আনন্দের, তার থেকে বেশি ‘গর্বের’ মনে হয়েছে আমার কাছে। বাস্তবিক অর্থে, প্রত্যেক পিতা-সন্তানের মধ্যে এ ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠা উচিত। মাত্র ৯ বছর বয়সেই পিতার প্রতি আমার সন্তানের এ ধরনের ‘কেয়ারিং’ আমাকে আপ্লুত করেছে, করেছে গর্বিত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বিষয়টা খুবই সামান্য; কিন্তু একটু ভাবুন তো—বিষয়টার গভীরতা কতটুকু! সত্যি বলতে, সন্তানের এ ধরনের ‘মানবিক’ কর্মকাণ্ড ও বাঙালি পরিবারের চিরচেনা ‘দৃঢ়বন্ধনে আবদ্ধ থাকা’র চিত্র হূদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো!
সন্তানের নিরাপত্তা বাবা-মায়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সন্তানের প্রতি সহজাতভাবেই বাবা-মা সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখেন। তাদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠাই মূল লক্ষ্য পিতামাতার কাছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ঐশ্বরিক, আত্মিক, যা কোনো মানদণ্ডেই পরিমাপযোগ্য নয়। বাবা-মায়ের খেদমত, খোঁজখবর, আদরযত্ন সন্তানের জন্য অনেক বড় ইবাদত। বাবা-মাই সন্তানের জন্য জান্নাত; আবার বাবা-মায়ের অনাদরেই পরকালের শাস্তি ও জাহান্নাম। সন্তানের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার কথা ভেবে কেবল বাবা-মাই খুব বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন। এজন্য সব ধর্মেই বাবা-মাকে সর্বাধিক সম্মান দেখাতে বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের নির্দেশনায় বাবা-মা যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অন্যায় আদেশ না করবেন, ততক্ষণ তাদের কথা মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। তাদের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যাতে তাদের প্রতি অশ্রদ্ধাবোধ কিংবা অসম্মান দেখানো হয়।
বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অন্যতম কর্তব্য হলো তাদের জন্য দোয়া করা। তাদের জীবদ্দশায় যেমন দোয়া করা, তেমনি তাদের মৃত্যুর পরও এ দোয়া অব্যাহত রাখা। সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৪-এ উল্লেখ আছে, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’ অর্থাত্, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের (বাবা-মা) উভয়ের প্রতি দয়া করুন; যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন করেছেন।’ হাদিসে এসেছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’ এবং ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হন; আবার পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হন।’ এ রকম পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তদ্রূপ, সন্তানের প্রতিও পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুভাবে বর্ণিত হয়েছে। পিতা-মাতাকে মনে রাখতে হবে, সন্তান মহান সৃষ্টিকর্তার অমূল্য নেয়ামত। সন্তান পৃথিবীতে পিতা-মাতার মান, সম্মান, মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাদের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম, নীতি ও আদর্শকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়। এমনকি পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের আদর্শকে জীবিত রাখে সন্তানসন্ততি।
কর্মব্যস্ত জীবনে অবশ্যই প্রতিটি সন্তানের সুস্থ বিকাশে বাবা-মাকে যথাসাধ্য খেয়াল রাখা উচিত। চলমান জীবনে আমার ও আমার সন্তানের মধ্যে ঘটে যাওয়া এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাজারো উদাহরণ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেয় আমাদের। উপরোল্লিখিত ঘটনায় মূলত সমস্যা ছিল একটাই—পিতার (আমার) টুথব্রাশের ক্যাপ কোনোভাবে হারিয়ে যাওয়া। এ ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়েই একে অন্যের প্রতি যত্ন, দায়িত্বের অংশ হিসেবে বাবা-ছেলের ভালোবাসার এই প্রাণান্তকর লুকোচুরি খেলা। আসলে এর পেছনে রয়েছে পারিবারিক ভালোবাসার সহজাত প্রবৃত্তি। প্রতিটি পরিবারে এভাবেই ‘চির অটুট’ থাকা উচিত বাবা-মা-সন্তানের পবিত্র বন্ধন। আজকের সমাজে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কিংবা সন্তানের ওপর পিতামাতার এমন সব অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের ঘটনার সংবাদ শোনা যায় মাঝেমধ্যে, যা মানুষ হিসেবে আমাদের ছোট, অপরাধী করে তোলে! পিতা-মাতার স্থান সবার, সবকিছুর ঊর্ধ্বে—এই কথা যেমন সন্তানকে সর্বদা মাথায় রাখতে হবে, অনুরূপভাবে সন্তানের সুস্থ, সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার স্বার্থে যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে পিতা-মাতাকে। সুস্থ সামাজিক রীতিনীতির কথা বলি কিংবা ধর্মশিক্ষার প্রসঙ্গই টানি—পিতা-মাতা, সন্তান সর্বোপরি প্রতিটি মানুষকে একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের শিক্ষাই দিয়ে থাকে।