মনে করা হচ্ছিল, অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার উত্তরণ ঘটিয়ে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াবে পাকিস্তান। ঠিক এমন একটি সময়ে রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক-বেসামরিক অফিসারদের হাত ধরে নজিরবিহীন অস্থিতিশীলতায় নিপতিত নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। স্মরণকালের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট’ ঘিরে ধরেছে পাকিস্তানকে। পবিত্র স্থান হিসেবে আখ্যায়িত ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতার করার জের ধরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সারা দেশ। এটি রাজনৈতিক কৌশল প্রতিরোধে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তাদের অক্ষমতার প্রতিফলক। যদি এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হয়ে থাকে পাকিস্তানের রাজনীতিকে ইমরান খানের হাত থেকে মুক্ত করা, তবে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, এর ফল হবে অত্যন্ত মারাত্মক। চলমান অস্থিরতার পিঠে চড়ে আগামী দিনে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
ইমরান খানের জনপ্রিয়তা কতটুকু বাড়ছে বা কমছে কিংবা রাজপথে আন্দোলন, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অস্থিরতা সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিছুটা ধারণা করতে পারে বটে, কিন্তু অন্য একটি বিষয়ে বাহিনীর গণনা নিছক ভুল বই আর কিছুই নয়! তাহলো, দানা বাধা অস্থিরতা জাতীয় অর্থনীতিতে কী ধরনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ফেলতে পারে, সে সম্পর্কে সামরিক বাহিনী আঁচ করতে কার্যত ব্যর্থ—এই কথা না বলে উপায় নেই। বহুদিন ধরেই ধুঁকছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। তীব্র মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পড়ে দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে আজকের পাকিস্তান। এসব কারণে অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে এবং জটিল আকার ধারণ করছে। সংঘাত-সংঘর্ষ ও বিভেদ বাড়ছে। অনেকের কৌতূহলোদ্দীপক জিজ্ঞাসা—‘সামরিক বাহিনীতেও কি বিভেদ মাথাচাড়া দেবে?’
এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে, অস্থিরতা, হানাহানি ও মারপিটের ভেতর দিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে পুঁজি করে সংবিধানের নির্দেশ মোতাবেক প্রাদেশিক ও জাতীয় নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার অজুহাত খুঁজতে পারে কোনো পক্ষ। এক্ষেত্রে মিশরীয় মডেলের অনুকরণে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটতে পারে পাকিস্তানে। সত্যিই যদি সেরকমটি ঘটে, তবে লম্বা সময় ধরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা গ্রাস করবে পাকিস্তানকে।
অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করার মতো ব্যাপার, বিক্ষোভের আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে পাকিস্তানে, সেই ক্রান্তিকালে বিদেশের মাটিতে অবস্থান করতে দেখা যায় দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে! লন্ডনে চার্লসের রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। পাকিস্তান যখন জ্বলছে, তখন শেহবাজ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কীভাবে ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ আরো বাড়িয়ে নেওয়া যায়। ১০ মে দেশে ফিরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণের ওপর চোখ ছিল অনেকের। আরো মজার ব্যাপার, একই সময়ে সেনাপ্রধান অবস্থান করছিলেন উপসাগরীয় অঞ্চলে। ত্বরিত দেশে ফিরতে না পারার কারণ হিসেবে তার ব্যক্তিগত বিমান বিভ্রাটের কথা জানা যায়। এ ধরনের নানা নাটক যখন একের পর এক সামনে আসতে থাকে, তার মধ্যেই খবর আসে, পাঞ্জাবের প্রতাপশালী তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রীও বসে আছেন বিদেশে!
যাহোক, সোজাসাপটা প্রশ্ন হলো—কঠিন পরিস্থিতি আসতে পারে, এমন আশঙ্কা সত্ত্বেও দেশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন কে বা কারা? লাহোরের কর্পস কমান্ডার হাউজ ও গভর্নর হাউজে হামলা চালানো গুটিকয়েক তাণ্ডবকারীকে ঠেকানো গেল না কেন? ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের অনুমতিই-বা কে বা কারা দিয়েছিল? সহজ ও পরিষ্কার প্রশ্ন—ভাঙচুর চালানোর সময় কোথায় ছিল নিরাপত্তারক্ষীরা? আরো বড় প্রশ্ন—সেই সব সামরিক রক্ষী কোথায় ছিল, যারা রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরের গেটটি উত্তেজিত জনতার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল অবলীলায়?
পাকিস্তানে স্মরণকালের যে ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা দেখা গেল, তা বহু প্রশ্নকে সামনে আনছে। পেশোয়ারের বালা হিসার দুর্গে ফ্রন্টিয়ার কর্পসের সদর দপ্তর ‘কবজা ও মুক্ত’ করতে বিক্ষোভকারীদের নির্দেশ দিয়েছিল কে? ইতিমধ্যে কয়েক জন পণ্ডিত ব্যক্তি অভিমত ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, এটি ছিল ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য একটি বিশেষ ‘মাস্টার প্ল্যান’, যা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি।
দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারী শত শত বিক্ষোভকারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে যেসব তথ্যউপাত্ত ও ঘটনার সময়কার কন্টেন্ট শেয়ার করছে, তাতে দেখা যাচ্ছে—তরুণ প্রজন্ম, যুব সমাজের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ মহিলারাও কঠিন স্বরে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনীর প্রতি! এর প্রতিক্রিয়ায় বেশকিছু ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নতুন করে ‘সামরিক চেকপোস্ট’ বসানো হয়েছে বটে, কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে? পাকিস্তানের বর্তমান বাস্তবতা হলো, শত্রুপক্ষের মাধ্যমেও যেখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করে না পাকিস্তান, সেখানে এক ধাক্কায় ‘কঠিন উত্তপ্ত’ হয়ে উঠল সারা দেশ!
সত্যি বলতে, পাকিস্তানে যে অবস্থা চলছে, তার জন্য পাকিস্তান নিজেই দায়ী। এই অবস্থায় সবখানে একটাই জিজ্ঞাসা—‘নেতারা কি এই বিষয়ে কথা বলবেন? ৯ মে যে জগাখিচুড়ি ঘটনা ঘটে গেল, তার দায় নেবেন? পাকিস্তানিরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যাখাসহ এর ‘স্পষ্ট’ উত্তর পাওয়ার দাবি রাখে। বিদেশে পাকিস্তানের বন্ধুরাও চাইবে এটাই। যারা সত্যিকার অর্থেই চায়, পাকিস্তান স্থিতিশীলতায় ফিরুক, উন্নয়নের ধারায় প্রত্যাবর্তন করুক, তাদের সবার একই প্রত্যাশা—আড়ালের ঘটনা আসলে কী ?
বি গত ১৮ মাস জুড়ে পাকিস্তানকে নিয়ে খেলা করছে দেশটির শীর্ষ পক্ষগুলো। ক্ষমতার মসনদকে শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি করার চিন্তা থেকে উপেক্ষা করে চলেছে আইনের শাসন ও জাতীয় স্বার্থ। বলা বাহুল্য, ক্ষমতা ধরে রাখার এই কুৎসিত খেলা পাকিস্তানের জন্য বয়ে এনেছে ‘ঘোরতর অন্ধকার’। পাকিস্তান বর্তমানে সংকটের গভীর খাদে নিমজ্জিত। অর্থনৈতিক মন্দা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে দেশটিকে। চলতি বছর মূল্যস্ফীতি ৪০ শতাংশের ঘর স্পর্শ করেছে, যা রেকর্ড।
ভুলে গেলে চলবে না, বারবার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির শিকার হতে হয়েছে পাকিস্তানকে। এসব ট্র্যাজেডি দেশ জুড়ে যে আকাল অবস্থার সৃষ্টি করে, তা সাধারণ নাগরিকদের জীবন বিষিয়ে তোলে। বর্তমানে এমনো অবস্থা চলছে কোনো কোনো এলাকায়, সন্তানের মুখে দুই বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। এভাবে চলতে থাকলে খাদ্য বিতরণের লাইনে পদদলিত হয়ে মারা পড়বে অনেকে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের উচিত হবে অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করা। জুনের পরে ‘খেলাপি’ এড়াতে চাইলে অতি সত্বর বিদেশি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে পাকিস্তানকে। বিগত কয়েক মাস ধরে ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ঋণদাতাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দেশটির সরকার। এর ফলাফল নিশ্চয় সুমিষ্ট হবে না দেশের জন্য। আইএমএফ, চীন সরকার ও মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তানের যেসব মিত্র রয়েছে, তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়।
৬ মে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ইসলামাবাদ সফরকালে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐকমত্য গড়ে তুলবে। স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে এবং আরো কার্যকরভাবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, যাতে করে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে ফেরে দেশ।’
কিনের এই আহ্বানের ঠিক দুই দিনের মাথায় শুরু হয় ‘হট্টগোল’! কারাগারে পাঠানো হয় তুমুল জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে। এর ফল যে ভালো হবে না, তা জানাই ছিল। ইমরানের অনুসারীরা শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তাই আজকের দিনে প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেইজিং, ওয়াশিংটন, রিয়াদ ও আরো কিছু ঋণদাতাগোষ্ঠী এই ঘটনায় কী ভাবছেন, তা কি আদৌ ভাবছে পাকিস্তানের বিভিন্ন পক্ষ? স্পষ্টভাবে বললে, এই খেলা বন্ধ না হলে দেউলিয়াত্বের মুখে থাকা পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যায়, তাই দেখার বিষয়।