প্রত্যেকটি মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে এবং তাদের নিজস্ব সভ্যতা, সামাজিকতা ও সংস্কৃতিধারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে মেনে চলে। সুস্থ সমাজব্যবস্থা এবং সুস্থ সামাজিকতা হলো প্রতিটি নাগরিকের মনুষ্যত্বের মস্তিষ্ক। তাই এটিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রত্যেকটি মানুষের। প্রতিটি মানুষ সে তার সামাজিকতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপনীতি মানতে বাধ্য থাকবে।
সমাজ সংস্করণের উন্নতি সাধন করার আগে দেশের সভ্যতা উত্কৃষ্টের ভার বহন করে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও গুণাবলি। আমাদের নিজস্ব যেসব সংস্কৃতি রয়েছে, যেসব সুনিপুণ গুণ রয়েছে এবং কৃতকার্যের কীর্তিসমূহ রয়েছে তা আমাদের আলোকিত সমাজব্যবস্থা তৈরি করার জন্য যথাসাধ্য কাজে আসবে। আমাদের সংস্কৃতিগুলো আমাদের সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করতে বিশাল এক ভূমিকা রাখবে, তবে আলোক শাখার আসনে বসানোর জন্য সবার প্রচেষ্টাও সমানভাবে থাকা চাই, তবেই এই কাজটি সহজলভ্যতার সঙ্গে এবং সুসংগঠিতভাবে সম্পাদনা করা যাবে।
আমাদের দেশে প্রধানত দুটি সংস্কৃতি রয়েছে। একটি হলো, গ্রামীণ সংস্কৃতি আর অন্যটি নগরসংস্কৃতি। সংস্কৃতি আবার দুই প্রকার, বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতি। বস্তুগত সংস্কৃতি হচ্ছে—মানুষের অর্জিত বা তৈরিকৃত দ্রব্যের সমষ্টি। সহজ কথায় বস্তুগত সংস্কৃতি হলো—যে সংস্কৃতি দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, তা-ই বস্তুগত সংস্কৃতি। বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে নাগরিকের চলাফেরার ধরন, আচরণবিধি, পোশাক-পরিচ্ছদ, বিভিন্ন আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা এবং বিভিন্ন উত্পাদন কৌশল ও হাতিয়ার হলো বস্তুগত সংস্কৃতির উপকরণ।
বস্তুগত সংস্কৃতি আর মানব সম্প্রদায় একই সুতোয় বাঁধা থাকলেও অবস্তুগত সংস্কৃতির স্থান হওয়া চাই একটু ভিন্ন রকমের অন্যতম মর্যাদায়। বস্তুগত সংস্কৃতিকে ধরাছোঁয়া গেলেও অবস্তুগত সংস্কৃতিকে ধরাছোঁয়া যায় না। তবে এই অস্পর্শ করা বা অবস্তুগত সংস্কৃতির দিকটি সমাজের মূল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বাহন হিসেবে প্রধান ভূমিকা রাখে বলে মনে করি। অবস্তুগত সংস্কৃতির উন্নতির ফলে বস্তুগত সংস্কৃতির উন্নতি ঘটে। তাই আগে অবস্তুগত সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, জ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও আইন। অবস্তুগত সংস্কৃতির নিয়মধারার মধ্যে যেসব উপকরণ বা বিষয়বস্তু রয়েছে তা আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতি পরিবর্তন করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে যথার্থ সক্ষম। তাই এ অবস্তুগত সংস্কৃতিকে সমাজ সংস্করণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে ধরা হোক।
আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও নগরসংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে অনেক দিক দিয়ে ভিন্নতা ও নানাবিধ পরিবর্তন। যেমন—গ্রামীণ সংস্কৃতিগুলো হলো কৃষি আত্মনির্ভরশীল সংস্কৃতি। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গ্রামীণ সংস্কৃতির পোশাক-পরিচ্ছদ, আবাসস্থল, খাদ্য, খেলাধুলা ও বিনোদন, কর্মনিষ্ঠা এবং চলাফেরা ও আচরণবিধি নগরসংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। সাবলীলতার সুনিপুণ এর মধ্যে থাকলেও শিক্ষার দিক দিয়ে গ্রামীণ জীবনধারা নগর সংস্কৃতি থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে আছে। পিছিয়ে আছে শিক্ষাগ্রহণের দিক দিয়েও। অন্যদিকে নগরসংস্কৃতিতে আধুনিক পরিচর্যা, মানসিকতা, স্মার্টকতা, জীবনযাপন, পোশাক-পরিচ্ছদ, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি উন্নত।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণেও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। জনসাধারণের চাহিদার অপূর্ণতার কারণে সমাজ সংস্করণে বাধাবিঘ্ন তৈরি হয়। আগেকার যেসব সমাজসংস্কারক তাদের অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, বুদ্ধিমত্তার মধ্য দিয়ে, অগোছালো সমাজব্যবস্থাকে সংস্করণ করেছে তার কৃতিত্ব অপরিসীম। কুসংস্কার, বিভিন্ন অযৌক্তিক প্রথা, বাল্যবিবাহ এবং সমাজের যেসব অনৈতিক কার্যক্রম রয়েছে, তা দূর করতে পারলেই সমাজব্যবস্থা তার সামাজিকতার আসনে ফিরে যেতে সক্ষম হবে। মানবজাতির কাছে তার সমাজ হতে হবে আয়নার মতো, যাতে করে এর মধ্যে সে নিজেকে দেখতে পারে।
গত শতাব্দীতে যারা অপরিসীম শ্রম, রক্ত, আন্দোলন এবং নিজেদের অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি সমাজকে যেভাবে পরিশুদ্ধ করে আলোর মুখ দেখিয়েছে, আমরাও সেভাবে আমাদের এই সমাজব্যবস্থাকে আলোকিত করে তুলতে চাই।