সারা বিশ্বের মতো ১৭ মে দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস-২০২৩। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন লিগ ও ইন্টারন্যাশনাল হাইপারটেনশন সোসাইটি এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন।’
অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ, যা প্রায়ই একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ খুবই জরুরি। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাত্ করে মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কী?
স্বাভাবিক রক্তচাপ হলো, সেই বল, যার সাহায্যে রক্ত শরীরের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছায়। হৃদপিণ্ডের পাম্পিং ক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তচাপ তৈরি হয়। রক্তচাপের কোনো একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। বিভিন্ন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একেক জনের রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের বেলায় বিভিন্ন সময়ে রক্তচাপও কমবেশি হতে পারে।
রক্তচাপ কত প্রকার : সাধারণত দুই ধরনের, সিস্টোলিক ও ডায়াস্টলিক। নরমাল সিস্টোলিক ১০০ থেকে ১৪০ এবং ডায়াস্টলিক ৬০ থেকে ৯০ মিমি মার্কারি। কারো ব্লাড প্রেশার যদি ১৪০/৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে। তবে বয়সভেদে তারতম্য হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ কি আসলেই কোনো জটিল ব্যাধি?
উচ্চ রক্তচাপ ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। এটাই উচ্চ রক্তচাপের সবচাইতে খারাপ দিক। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন—হৃদপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে কার্যকারিতা হারাতে পারে। চোখের রেটিনাতে রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে পারে।
কী কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়?
কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়, যেমন : বংশানুক্রমিক :উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাহলে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে।
ধূমপান : ধূমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনি, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তামাক, জর্দা, গুল ব্যবহারে একই সমস্যা হতে পারে।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ : খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়।
অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা : যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। অধিক ওজনসম্পন্ন লোকের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন—মাংস, মাখন এবং ডুবোতেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়বে। কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেস্টরল বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত মদ্যপান : যারা নিয়মিত অত্যধিক পরিমাণে মদ্যপান করে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়। অ্যালকোহলে অতিরিক্ত ক্যালরি থাকে।
ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিস রোগীদের অথারোসক্লেরোসিস বেশি হয়। ফলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এছাড়া তাদের অন্ধত্ব ও কিডনির নানা রকম রোগ হতে পারে।
অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা : অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে, তবে এই উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
অন্যান্য কারণ : কিছু কিছু অঙ্গ আক্রান্ত হলে রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন।
এই কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো : কিডনির রোগ। অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার। ধমনির বংশগত রোগ। গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি অ্যাকলাম্পসিয়া হলে। অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড গ্রহণ এবং ব্যথা নিরামক কিছু কিছু ওষুধ সেবন করলে।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কী করা উচিত?
অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে। খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।
খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা : কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন—খাশি বা গরু মাংস, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা, কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননি তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন—সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো।
লবণ নিয়ন্ত্রণ : তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম : সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি।
ধূমপান বর্জন : ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে : নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের শখের কাজ করার মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।
রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা : নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিলতা হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কি চিকিৎসা করাতেই হবে?
উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে। অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন, মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কি? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনোক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরেও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না। কারো কারো ধারণা একবার ওষুধ খেলে তা আর বন্ধ করা যাবে না। আবার কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে, উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না বা প্রয়োজন মনে করেন না। এই ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভুল। এই ধরনের রোগীরাই হঠাত্ করে হূদেরাগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে। যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদের অবশ্যই ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে। নিয়মিত সারা জীবন ওষুধ সেবন করতে হবে এবং নিয়মিত চেক করাতে হবে।