সারা দেশের মফস্বলের দরিদ্র-অতিদরিদ্র জনগণকে তাদের নিজ এলাকায় থেকে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টার অন্ত নেই। এজন্য হাজার হাজার এনজিও, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে বেশ জোরেশোরে কাজ করে চলেছে, তাদের যথেষ্ট পরিমাণ ঋণ প্রদান করা হয়েছে। নদীভাঙা, ভিটেমাটিহীন, ভাসমান মানুষদের কয়েক যুগ আগে থেকে গুচ্ছগ্রাম বানিয়ে ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর যাবত আরো উন্নত মানের আবাসন প্রকল্প তৈরির মাধ্যমে গৃহহীনদের জন্য স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এসবের উদ্দেশ্য গ্রামের অভাবী, বাস্তুহারা মানুষকে গ্রাম থেকে দেশের উন্নয়নের কাজে লাগানোর জোর প্রচেষ্টা চালানো।
কিন্তু মফস্বলের দরিদ্র জনগণ নানা ছলছুতায় সেসব ছেড়ে শহরের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। এর নানামুখী কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ অর্থনৈতিক হিসেবে ধরা হলেও সেটা শুধু অর্থনৈতিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন।
মফস্বলের দরিদ্র -অতিদরিদ্র জনগণের কল্যাণে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে। অনেক মাঠ গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য তারা একেক জন একই সঙ্গে অনেকগুলো ঋণদান প্রতিষ্ঠানের আওতায় সুবিধাভোগী সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন। আর যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন, তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় খাদ্য, ভাতা ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। তার সঙ্গে অনেকের রয়েছে বিভিন্ন ছোটখাটো বৃত্তি। সবকিছু মিলে জীবন নির্বাহের জন্য গ্রামীণ এসব মানুষ গ্রামে থেকে যেতে পারলে বেঁচে থাকা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে অন্য জায়গায়।
এক নমুনা জরিপে দেখা গেছে,মফস্বলের -অতিদরিদ্র জনগণের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাবোধ সবচেয়ে বেশি। এই নিরাপত্তাহীনতাবোধ প্রধানত দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি তাদের কর্মনিরাপত্তাহীনতা। অন্যটি চরম হতাশা। এই হতাশার উৎপত্তি বিভিন্ন ধরনের রোগ-শোক, পারিবারিক কলহ, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ, রাজনৈতিক মতাদর্শের বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা, জীবননাশের হুমকি, জমি, ভিটেমাটি দখল করে উচ্ছেদ আতঙ্ক ইত্যাদি নানা সমস্যার সঙ্গে জড়িত।
এছাড়া কেউ অন্যের জমি লিজ নিয়ে ফলের বাগান বা শস্যের আবাদ, মুরগির খামার, পুকুরে মাছ চাষের জন্য ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্ট করলেও সেখানে চরম কর্মনিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়ে হতাশার মধ্যে কালাতিপাত করে গ্রামের সবকিছু ছেড়ে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। তাদের এসব নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় যখন নির্দিষ্ট চাঁদার টাকা না পেয়ে দুর্বৃত্তরা ফলবতী কলা, পেয়ারা, আম ইত্যাদির বাগানের গাছ রাতের আঁধারে কেটে সাবাড় করে দেয়। অথবা মাছের পুকুরে বা মুরগির খামারে বিষ প্রয়োগ করে গ্রামের একজন ভূমিহীন নিরীহ শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তার স্বপ্ন-সাধকে রাতের আঁধারে নিমেষেই ধুলোয় মিশিয়ে দেয়! এছাড়া এসব দুর্বৃত্ত দল বেঁধে ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করে ফেলে। জিনের বাদশার প্রতারণা কিছুটা কমে গেলেও বর্তমানে মাদক ব্যবসায় সক্রিয় হয়ে পড়েছে অনেক গ্রামের এসব টাউটরা। তারা সীমান্ত জেলাগুলোতে রাতের বেলা চোরাচালান করে এবং দিনের বেলা মোবাইল ফোনে অপরাধ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করে বিভিন্ন পুরস্কারের লোভ দেখায় এবং আর্থিক লেনদেনের উৎস খুঁজে সেই সূত্র ধরে বিকাশ, ইমো, মোবাইল ব্যাংকিংকে তাদের বড় টার্গেট করে ফেলে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বখরার বিনিময়ে এসব প্রতারণার পৃষ্ঠপোষকতা করে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় তারা এসব নিত্যনতুন অপরাধ ট্রেস করতে পারেন না এবং তাদের কাছে গেলে এসব অভিযোগের কোনো সুরাহা হয় না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
কোনো বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই গ্রামে এদের অনেকের পাকা একতলা-দোতলা বাড়ি, নতুন মডেলের মোটরবাইক, সোয়া লাখ টাকা দামি মোবাইল ফোনসেট, বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। পাঁচ-ছয় বছর পূর্বে যাদের চালচুলো ছিল না তারা চাঁদাবাজি, জুয়া, মাদক এবং মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা করে অল্পদিনেই তারা ধনী সেজে গেছে। গ্রামের উঠতি বয়সের তরুণদের তারা দলে ভিড়িয়ে এসব ভয়ংকর অপরাধ শেখাচ্ছে।
এই ধরনের প্রতারণা ও বর্বর ঘটনা মফস্বলের শিক্ষিত, সাক্ষর, দরিদ্র-অতিদরিদ্র জনগণ অবলোকন করে চরম নিরাপত্তাহীনতা মনে করে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ফেলছে। এটা আমাদের দেশের মফস্বলের বা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখন একটি বড় বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শুধু ঋণের টাকা ঢাললেই যে গ্রামের উন্নতি হবে তা এখন উন্নয়ন-পরিকল্পকদের বড় প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে।
কারণ, এসব ভুক্তভোগী দরিদ্র মানুষ হীন ভিলেজ পলিটিকসের জাঁতাকলে পড়ে আইনের দ্বারস্থ হতে ভয় পান এবং সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। কেউ বেশি সাহসী হয়ে আইনের দোরগোড়ায় গেলে তাকে ঘুসের ফাঁদে ফেলে আইনের মানুষ ও রাজনৈতিক নিগ্রহের সিন্ডিকেটের মধ্যে জড়িয়ে আরো বেশি আর্থিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
এই জটিল বিষয়গুলো মফস্বলের বিত্তশালী, স্থানীয় নেতা, দরিদ্র-অতিদরিদ্র জনগণের মধ্যে জড়িয়ে গিয়ে অনেক গ্রাম কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অনেক উত্তরদাতা জানিয়েছেন বর্তমানে মফস্বলের জনগণের মধ্যে এই খারাপ বৈশিষ্ট্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকাল এমন কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে এ ধরনের জটিল সংঘাতময় পরিস্থিতি নেই। জমিজমা, গরুছাগল, হাঁসমুরগি নিয়ে ভাই-ভাই বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সামান্য বিবাদের সূত্র শুরু হলে সেগুলোকে তিলকে তাল করে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত, খুনখারাবি পর্যন্ত গড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। স্থানীয় থানা বা আদালতে এসব মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন একজন সত্ আইনজীবী। কিন্তু তারা নিজেরা আইনের লোক হয়েও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাদের সিন্ডিকেটের ঘৃণ্য কার্যকারিতার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে নিজেদের খুব অসহায় ও নিরাপত্তাহীন মনে করেন। কাজে বাধা, উৎপাদনে, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে বাধা ও চাঁদা এমনকি অটোরিকশা চালকের কাছ থেকে নানা সমিতির নামে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় থেকে মফস্বলের দরিদ্র-অতিদরিদ্র জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক বা কর্মনিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাবোধ সবচেয়ে বেশি। এভাবে গ্রামের সিংহভাগ মানুষ শহরের দিকে ধাবমান হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি (১৮.৫.২০২৩ প্রকাশিত) গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ঢাকায় গরিব মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।…ঢাকায় ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ নতুন দরিদ্র হয়েছে।’ শহরে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সংকীর্ণ। গ্রামের তুলনায় শহরে দরিদ্রদের জন্য অনেক ধরনের নিরাপত্তা ভাতা নেই। কারণ, শহরে ভাসমান মানুষদের অনেকে কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, কার্ড করার উপায় নেই।
গ্রামীণ শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। সেখানকার পুরুষরা অটোরিকশা চালিয়ে ভাড়া নিয়ে দূরবর্তী শহরে কাজ করতে গেলেও নারীরা দিনরাত ঘরে বেকার বসে থাকছে। গ্রামে ঝিয়ের কাজও নেই। পেটের দায়ে একসময় তারাও পরিবার নিয়ে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী প্রভৃতি বড় শহরে পাড়ি জমাচ্ছে।
কারণ, আমাদের দেশে শহরকেন্দ্রিক একমুখী উন্নয়নভাবনা গ্রামীণ দরিদ্রদের বেঁচে থাকার তাগিদে অনবরত শহরে স্থানান্তরের হাতছানি দিচ্ছে। উপমহাদেশে রেলপথ বানিয়ে ব্রিটিশরা যেমন পাট, সুতা, চা, মসলা ইত্যাদি দ্রুত পরিবহন করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজে করে লন্ডন, ডাবলিন, ম্যানচেস্টারে পাঠিয়ে দিত ঠিক তেমনি আজকাল মফস্সলের অতিদরিদ্র জনগণ নিজেরাই সস্তা শ্রমপণ্য হিসেবে বিবেচিত বিধায় , দালালের মাধ্যমে দ্রুতগামী বাস-ট্রেনে চেপে গ্রামের মায়া ছেড়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নগরে পাড়ি জমাচ্ছে।
এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিদ্যুতের ব্যবহার শুধু ছোটখাটো মুদি দোকানদারি ও অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জে গতি আনলেও সেটা সবার জন্য উৎপাদীতমুখী নয়। তাই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য দিয়ে কলকারখানা স্থাপন করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করার দাবি এখন চলতি সময়ের মূল্যবান বিষয়। এটাকে দ্রুত আমলে নিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য এগিয়ে আসা উচিত। অন্যদিকে সুবিধাভোগী চাঁদাবাজ পাতিনেতা ও টাউট-মাস্তানদের বহুমুখী হুমকি ও হয়রানি ঠেকিয়ে গ্রামের নিরীহ সত্ মানুষকে গ্রামে থাকার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিতে হবে।