আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ হীনম্মন্যতায় ভুগছে, যার একটি বড় অংশ তরুণ প্রজন্ম। শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় হীনম্মন্যতা অর্থ নিজেকে হীন কিংবা নীচ ভাবার প্রবণতা। বৃহদার্থে চিন্তা করলে হীনম্মন্যতা এমন এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যা নিজের ভালো দিকগুলোকে অস্বীকার করে নিজেকে অহেতুক অন্যের তুলনায় দুর্বল ভাবতে বাধ্য করে।
প্রাত্যহিক জীবনে প্রায়ই আমরা এমন কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, যেখানে আশপাশের মানুষ আমাদের ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে। পিছিয়ে পড়া মানুষটি ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি দিয়ে আবার সামনের দিকে ধাবিত হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত হয় তখন, যখন অন্য কারো সাফল্য আমরা সহজভাবে মেনে নিতে পারি না। অথবা অন্য কারো তুলনায় নিজেদের কম যোগ্যতাসম্পন্ন কিংবা কম আকর্ষণীয় মনে করতে শুরু করি। মনস্তত্ত্বের ভাষায় এটিকে ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’ও বলা হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড এডলার বিশ শতকে সর্বপ্রথম শব্দটিকে ব্যাখ্যা করেন ‘শ্রেষ্ঠত্বের প্রচেষ্টা’ হিসেবে। অর্থাৎ, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কেউ নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণত ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স শৈশবের কোনো জটিল অভিজ্ঞতার কারণে তৈরি হয় বা এমন কোনো পরিবারে শিশুর বেড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত হয়, যেখানে শিশুকে ক্রমাগত হেয় করা হয় কিংবা ছোট ছোট সাফল্যে প্রশংসা কিংবা উৎসাহিত না করে বরং সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করতে না পারায় কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করা হয়, যা কোনো শিশুর বিকাশে ভালো বোধ তৈরি করতে পারে না।
বর্তমানে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স বা হীনম্মন্যতার ধারণা আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। বর্তমানে অসহায় বোধ করা, পরিচয়ের সংকটে ভোগা, পরনির্ভরশীল হওয়া, অপরাধবোধে ভোগা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবও ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সের অন্তর্ভুক্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রতিনিয়ত এ ধরনের সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। এর পেছনে কেবল পরিবার নয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের বর্তমান সামাজিক পরিবেশকে দায়ী করা যায়। কেননা, আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বা শিক্ষাগত সাফল্য, মানুষের শারীরিক গঠন, বাহ্যিক সৌন্দর্য, উচ্চতা এমনকি গায়ের রং দিয়ে সমাজে মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করা হয়। সম্প্রতি মেডিক্যালে চান্স না পাওয়া শিক্ষার্থী হাফসা, রুয়েট শিক্ষার্থী রুমি ও বুয়েট শিক্ষার্থী রাফি—এই তিন জনের আলোচিত আত্মহত্যা বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করছে।
আমাদের আশপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা খুব অল্পতেই ভেঙে পড়েন। তাদের প্রয়োজন একটু অনুপ্রেরণা, একটু সামাজিক সমর্থন। অথচ কারো ইতিবাচক দিকগুলোকে উৎসাহিত করা দূরের কথা, মানুষের দুর্বল জায়গাগুলোকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছি। এই বিপজ্জনক সামাজিক অসদাচরণ যে কেবল দুর্বলদেরই হীনম্মন্যতায় ভোগাচ্ছে তা কিন্তু নয়। এই সমাজ যেমন শ্যামবর্ণ মেয়েদের সাফল্য অর্জন করতে দিতে চায় না, একই সঙ্গে প্রচলিত বর্ণনায় সুন্দরী মেয়েদের সাফল্যকেও ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। ঠাট্টা-বিদ্রুপ কিংবা উদ্দেশ্যমূলক প্রশংসায় খুব কৌশলে সমাজ বুঝিয়ে দিতে চায় সুন্দরী মেয়েটির সাফল্যের পেছনে যোগ্যতা নয়, অগ্রাধিকার পেয়েছে তার সৌন্দর্য। তাই মেধা খাটিয়ে, কঠোর শ্রম দিয়ে সফল হওয়া মেয়েটিকেও দিন শেষে বালিশ ভেজাতে হয় কেবল সমাজের চোখে সুন্দরী হওয়ার অপরাধে।
সমাজের কাঠগড়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা বোঝা যায় যখন তথাকথিত সমাজ বিশ্লেষকেরা বলেন, ‘উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা সংসারী হয় না বিধায় তাদের ডিভোর্স হয় বেশি।’ অথচ মাত্র কিছুদিন আগের কথা, যখন নিরক্ষর কিংবা স্বল্পশিক্ষিত মেয়েদের হেয় করা হতো। কারণ স্বামীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারে সমান অবদান রাখতে তারা ব্যর্থ হতো। অথচ মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে মেয়েদের হীনম্মন্যতায় ভুগতে হচ্ছে কেবল উচ্চশিক্ষিত হওয়ার কারণে। এমন সহস্র উদাহরণ দিয়ে সমাজের বর্তমান চিত্র তুলে ধরা সম্ভব, যা কিনা বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, হীনম্মন্যতায় ভোগাচ্ছে এবং অবস্থা যখন চরমে পৌঁছাচ্ছে, তখন কেউ কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।
তরুণেরাই দেশের মূল্যবান সম্পদ। প্রতিযোগিতাপূর্ণ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে সমাজ, দেশ তথা রাষ্ট্রের যেমন প্রয়োজন সুনাগরিক, তেমনিভাবে প্রয়োজন সম্ভাবনাময়ী, উদ্যমী ও আত্মবিশ্বাসী একটি তরুণ প্রজন্ম। এই প্রজন্মের নিরাপত্তা বিধান করা, তাদের সাফল্যের পথ সুগম করে দেওয়া সমাজের প্রতিটি মানুষের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।