ঝড় যত প্রবল হয়, তা থেমেও যায় ততই দ্রুত। সেটাই আরেক বার প্রমাণিত হলো। ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের বর্ণবাদের শিকার হওয়া এবং তার প্রতিবাদ ইস্যুতে ফুটবল দুনিয়ায় যে প্রবল ঝড় উঠেছিল, তা দ্রুতই থামিয়ে দিল ন্যয়বিচার। বর্ণবাদ ইস্যুতে দ্রুতই ন্যয়বিচার পেলেন রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র।
ঘটনার তিন দিনের মাথায় ভিনিসিয়ুসের লাল কার্ড তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে তার ওপর থেকে উঠে গেছে লাল কার্ডের শাস্তি এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞার খড়্গও। মানে রিয়ালের পরের ম্যাচেই খেলতে পারবেন তিনি। তার চেয়েও বড় কথা, ভিনিসিয়ুস ইস্যুতে প্রতিপক্ষ ভ্যালেন্সিয়ার মেস্তালা স্টেডিয়ামের গ্যালারির সেই অংশটা পাঁচ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ভ্যালেন্সিয়াকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে ৪৫ হাজার ইউরো, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫১ লাখ ৭৭ হাজার ৭৪৫ টাকা। সঙ্গে বরখাস্ত করা হয়েছে ম্যাচের মূল রেফারি ও ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারিসহ ছয় অফিশিয়ালকে।
গায়ের রং কালো বলে ভিনিসিয়ুস স্পেনে প্রতিনিয়তই বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে গেলেই প্রতিপক্ষ সমর্থকদের বর্ণবাদী বিষের শিকার হয়ে আসছেন। বারবার প্রতিবাদ-অভিযোগ করেও তেমন প্রতিকার পাচ্ছিলেন না। তবে গত রবিবার ভ্যালেন্সিয়া ও রিয়াল মাদ্রিদের মধ্যকার লা লিগার ম্যাচে ভিনিসিয়ুসকে ঘিরে বর্ণবাদ উত্তাপ আগের সব ঘটনাকে ছাপিয়ে যায়। ম্যাচের শুরু থেকেই ভিনিসিয়ুসকে লক্ষ্য করে নানা রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের স্লোগান দিচ্ছিল ভ্যালেন্সিয়ার সমর্থকেরা। ৭৩ মিনিটে তো ভিনিসিয়ুসের ধৈর্যের বাদই ভেঙে ফেলে দর্শকেরা। মেস্তালা স্টেডিয়ামের ‘মারিও কেম্পেস’ স্ট্যান্ড থেকে তাকে সরাসরি ‘বানর’ বলে গালি দেওয়া হয়। মেজাজ হারিয়ে ভিনিও দর্শকদের উদ্দেশে কিছু একটা বলেন।
এ ঘটনার পর ভিনিসিয়ুস বল ধরলেই তাকে অযথাই কড়া ট্যাকল করে উত্ত্যক্ত করেন ভ্যালেন্সিয়ার খেলোয়াড়েরা। পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার ধারণ করে যে, বেশ কয়েকবার দুই দলের খেলোয়াড়েরা সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েন। ৯৭ মিনিটে তো ধাক্কাধাক্কি রূপ নেয় হাতাহাতিতে। রাগের মাথায় ভিনি ভ্যালেন্সিয়ার হুগো দুরোর মুখে ঘুসি মেরে বসেন। এ ঘটনাতেই ভিনিসিয়ুসকে ম্যাচে দ্বিতীয় বারের মতো দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখান রেফারি, যা মূলত লাল কার্ড।
ম্যাচ শেষে ভিনিসিয়ুস সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক পোস্টে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি সরাসরি অভিযোগের তির ছোড়েন স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন (আরএফএফ) ও লা লিগা কর্তৃপক্ষের দিকে। মুহূর্তেই ভিনির সেই পোস্ট ফুটবল দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। স্বয়ং ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভাসহ বিশ্বের সাবেক-বর্তমান তারকা ফুটবলাররা ভিনির পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। ভিনিসিয়ুসের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ সরাসরি আরএফএফের কাছে অভিযোগ করে। এমনকি রিয়াল আদালতে যাওয়ার হুমকিও দেয়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে স্পেনের প্রোসিকিউটর অফিস দ্রুতই ঘটনার তদন্ত শুরু করে। পুলিশ দ্রুতই অভিযান চালিয়ে মোট সাত জনকে গ্রেফতার করে। তার মধ্যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয় রবিবারের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে। বাকি চার জনকে গ্রেফতার করা হয় গত জানুয়ারির এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আরএফএফের কম্পিটিশন কমিটি দ্রুতই ঘটনার তদন্ত করে ভিনিসিয়ুসের লাল কার্ড তুলে নিয়েছে। মাঠের মূল রেফারিসহ ছয় ম্যাচ অফিশিয়ালকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ভ্যালেন্সিয়াকে আর্থিক জরিমানা করার পাশাপাশি ‘বানর’ গালি উড়ে আসা মেস্তালা স্টেডিয়ামের সেই ‘মারিও কেম্পেস’ স্ট্যান্ডকে আগামী পাঁচ ম্যাচ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরে এক বিবৃতিতে কম্পিটিশন কমিটি জানিয়েছে, ‘রেফারি ম্যাচে ঘটে যাওয়া ঘটনার একটি খণ্ডিত অংশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। অবশ্য প্রকৃত ঘটনা পুরোপুরি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’ ভ্যালেন্সিয়া অবশ্য এই রায়ে সন্তুষ্ট নয়। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ‘অন্যায়’ ও ‘বিভ্রান্তিকর’। তদন্তের পর পুলিশের বিবৃতির সঙ্গে কম্পিটিশন কমিটির সিদ্ধান্ত পরস্পর বিরোধী বলেও দাবি ভ্যালেন্সিয়ার। তাই তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের কথাও ভাবছে। ভ্যালেন্সিয়া সত্যিই আপিল করবে কি না, সেটা তাদের বিচার। তবে ভিনিসিয়ুস সত্যিকার অর্থেই ন্যয়বিচার পেয়েছেন। তাতে বলা যায় আপাতত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিতলেন ভিনিসিয়ুস। ক্ষোভ-কষ্ট ভুলে তিনি নিশ্চয় রায়ে খুব খুশি। খুশি ভিনির পাশে দাঁড়ানো ফুটবল দুনিয়াও।