একটি দেশের বাজেটের তিনটি প্রধান লক্ষ্য থাকে—উৎপাদন, উন্নয়ন ও কল্যাণ। এই বাজেটের মাধ্যমে একটি দেশের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা থাকে, সঙ্গে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা থাকে। সর্বোপরি সবার কল্যাণ সাধনের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। কিন্তু এ ধরনের একটি বাজেট প্রদানে আমাদের দেশের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কতটা সফল হয়?
আমাদের দেশে বাজেটগুলো, বিশেষ করে রাজস্ব বাজেট তৈরি করেন নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্ম কর্তা । সেখানে এই বাজেটের যে তিনটি লক্ষ্য থাকে, তা কতটা গুরুত্ব নিয়ে করা হয় তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। তা ছাড়া এই বাজেটের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার। কারণ, সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জন করতে হয় এই বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে। সুতরাং এদিক থেকে দেখলে কাজটি হচ্ছে রিলে -রেইসের মতো।
প্রথম লক্ষ্য তথা উৎপাদন বৃদ্ধি ততটা অগ্রাধিকার পায় না, যতটা পাওয়া দরকার। যেমন—বাংলাদেশে বেকার সমস্যাকে কেবল বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দিয়ে না বসে থেকে সরকারিভাবে এর জন্য নীতিগত, কৌশলগত, কর, ভ্যাট, বিদেশি বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তার বিষয়টি শতভাগ গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করতে হয়। এর জন্য পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যের সঙ্গে মিল রেখে করা দরকার। এই কাজ যত দক্ষতার সঙ্গে করা যাবে, তত বেশি দেশ উন্নত হবে এবং আর্থিক সমৃদ্ধি আসবে। তার জন্য একটি সমন্বিত বাজেট করতে যে অনুশীলন ও গবেষণা দরকার, তার কতটা আমরা করতে পেরেছি তা খতিয়ে দেখা দরকার।
উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কোন কোন ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তার জন্য কী ধরনের বরাদ্দ থাকতে হবে, দেশ -বিদেশের উৎপাদনের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করে নিজ দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা দিতে হবে, বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কীভাবে সম্পৃক্ত হবে, এসব বিষয় নিয়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞান থাকা দরকার, কিন্তু বাস্তবে তার কতটুকু আমাদের রয়েছে?
দ্বিতীয় যে বিষয়টি থাকে তা হচ্ছে উন্নয়ন। এই উন্নয়নের বহুবিধ বিষয় ও সেক্টর রয়েছে। উন্নয়নের লক্ষ্য প্রতিফলিত হয় প্রতি বছরের উন্নয়ন বরাদ্দের মাধ্যমে। আর এই উন্নয়নের লক্ষ্য পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে মিল কতটুকু রয়েছে, কোথায় কোথায় অসংগতি রয়েছে এবং তা কীভাবে দূর করা হচ্ছে? এদিকে আমাদের বিগত যে দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা রয়েছে, তথা সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, তা যথেষ্ট যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়নি। এ দুটির কিছু অংশ ভালো হলেও কিছু অংশ অত্যন্ত দুর্বল। ফলে এর সঙ্গে সংগতি রেখে বার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করলে যে খুব ভালো ফল দেবে—এমনটা আশা করা ঠিক নয়। এ ছাড়া বিগত কোভিড -১৯ -এর কারণে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার কিছু অর্জন করা সম্ভব হয়নি। যদি তা অর্জন করতে হয়, তার জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগ এবং নব উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। যারা এর মধ্যে পিছিয়ে পড়েছে, তাদের কীভাবে অগ্রগামী করতে হবে, তা নির্ধারণ করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের জাতীয় উন্নয়নের মোট ১৫টি সেক্টরে উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া স্থানীয় সরকারগুলোকে যেমন—ইউপি, উপজেলা, জেলা প্রভৃতিকেও বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এই বরাদ্দের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারিত থাকে কি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য বোঝা যায়, যেমন—কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন বা রোড হবে এবং তা মোট লক্ষ্যের কতটুকু। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বোঝা যায় না, অর্থাৎ মোট সমস্যার কত অংশ সমাধান করবে। আর সেই গতিতে আগাতে থাকলে সেই সমস্যার সমাধান করতে কত সময় লাগবে। তাই একদিকে কিছু কিছু বিষয়ে অগ্রগতি অর্জন করলেও আবার অন্যদিকে অনেক কিছু পিছিয়ে যাচ্ছে, যেমন—শিক্ষার গুণগত মান এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল রাখার বিষয়টি।
আর তৃতীয় যে বিষয়টি থাকে, সেটি হচ্ছে সব মানুষের কল্যাণ সাধন করা। এখানে বিভিন্ন ধরনের বিষয় যেমন—বিভিন্ন ভাতা, পেনশন, দুর্যোগ -পরবর্তী করণীয়, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় করা হয়। কিন্তু এই ব্যয়ের ক্ষেত্রে মোট চাহিদার কতটুকু পূরণ করা হচ্ছে তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকে না। যেমন—অনাথ শিশু, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকে না। সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষ কীভাবে এ সমস্যার সমাধান কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারে, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। তাই বর্তমান বাজেট তৈরির পদ্ধতিতে আরও পরিবর্তন আনা দরকার।
বাজেট তৈরির কাঠামোতে যে পরিবর্তন আনা দরকার তা হচ্ছে—১. চাহিদাভিত্তিক বাজেট তৈরির কাঠামো অনুসরণ করা; ২. বাজেট তৈরির আগে বিভিন্ন পেশাদার গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করা। বর্তমানে কেবল ব্যবসায়ীসহ দু-একটি পেশাদার গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এখানে কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বেকার, শ্রমিক, বড় ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এনজিও, নারী সংগঠন, শিশু সংগঠন, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার; ৩. দ্বৈত কর যথাসম্ভব পরিহার করা এবং ৪. যার কোনো আয় নেই তার ট্যাক্স রিটার্ন প্রদান বাধ্যতামূলক না করা।
সরকারের আয়ের ক্ষেত্রে যা করা দরকার তা হচ্ছে—১. করযোগ্য সবার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা; ২. প্রাইভেট গাড়ির ওপর বাৎসরিক করের পরিমাণ বাড়িয়ে কমপক্ষে ৩৫ হাজার করা; ৩. সরকারের প্রতিটি বিভাগকে আয়ের একটি নির্দিষ্ট টার্গেট দেওয়া; ৪. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের টার্গেট দেওয়া; ৫. স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব আয়ে উদ্বুদ্ধ করা এবং তার সঙ্গে বার্ষিক বরাদ্দের একটি সম্পর্ক তৈরি করা; ৬. বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মিত সরকারি পাওনা টাকা আদায় করা; ৭. সম্পদ কর চালু করা; ৮. চিকিৎসক, উকিলসহ বিভিন্ন পেশাদার গ্রুপ থেকে অনলাইনে মাসিক কর আদায় করা; ৯. বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে তা থেকে আয় বাড়ানো।
আর সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান করণীয় হচ্ছে—১. চাহিদাভিত্তিক বাজেট তৈরি করে ১০-১৫ শতাংশ অপচয় কমানো; ২. আর্থিক বিশ্লেষক নিয়োগ করে প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় ১০-১৫ শতাংশ কমানো; ৩. সরকারের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জনকল্যাণে ব্যয় বৃদ্ধি করা; ৪. ভর্তুকির ক্ষেত্রে আরও বেশি ফলাফল যাচাই করে তা অব্যাহত রাখা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কমানো এবং কিছু ক্ষেত্রে বাড়ানো। যেমন—তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে কমানো আর সার, কীটনাশক ইত্যাদির ক্ষেত্রে তা বাড়ানো; ৫. চাল, ডাল, পেঁয়াজ, লবণ, চিনি, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম যুক্তিসংগত পর্যায়ে রাখা, অর্থাৎ উৎপাদনকারী ও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে একটি গড় দাম ঠিক করা; ৬. বেকারত্ব দূরের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় করা। বিশেষ করে কর্মসংস্থান শাখাকে সক্রিয় করা; ৭. গবেষণা খাতে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ঝুঁকি হ্রাস করা।
কল্যাণ খাতে যা করা দরকার তা হচ্ছে—১. গরিবদের জন্য বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানো এবং তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা; ২. আটটি বিভাগে অন্তত আটটি মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা এবং রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ মানসিক রোগীদের রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; ৩. রাস্তায় পড়ে থাকা অনাথদের সরকারি-বেসরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পুনর্বাসন করা; ১১. ওষুধের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা; ১২. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়িয়ে উন্নয়ন ও উৎপাদনে অবদান রাখা; ১৩. বয়স্ক নাগরিকদের কম মূল্যে ওষুধ ও রেশন দিয়ে বয়স্ক দারিদ্র্য কমিয়ে আনা; ১৩. পিপিপি ব্যাপকভাবে চালু করে সরকারি ব্যয় কমানো; ১৪. আয়বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য বাজেটে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া; এবং ১৫. দেশের সব প্রবীণকে পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা।