বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভসে লিখেছেন, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সাবেক ডেপুটি চিফ অফ মিশন জন ড্যানিলোভিজ। লেখাটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে উৎসাহিত করতে গত ২৪ মে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। এ পদক্ষেপের পর যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা আগে থেকেই অনেকটা অনুমান করা গিয়েছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকরা এ পদক্ষেপের গুরুত্ব রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ আসলে অবাধ নির্বাচন আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিকেই সমর্থন করছে। পাশাপাশি তারা সাবধান করে দিয়ে বলছে, ভোটের সময় সহিংসতায় জড়িত থাকা বিরোধী দলের কর্মীদের ক্ষেত্রেও এ ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে। আবার বাংলাদেশ সরকারের সমালোচকরা এ পদক্ষেপকে দেখছেন অন্যভাবে। তারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের বিরোধী দলকে সমর্থন দিচ্ছে এবং বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের পক্ষে এক ধাপ অগ্রসর হয়েছে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এ দুইটি ধারণার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রেখে শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার গুরুত্বের ওপর ফোকাস রাখার চেষ্টা করছে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদাররা এখন পর্যন্ত এ নিয়ে চুপ রয়েছে। তারা পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে, কী হয় তা বুঝে উঠতে অপেক্ষা করছে।
যেকোনো নীতির মতোই নতুন মার্কিন ভিসা নীতির চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করবে এর বাস্তবায়নের ওপর।
যারা নতুন নীতি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন তাদের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ভয় দেখানোর অভিযোগগুলো তদন্ত ও মূল্যায়ন করা মার্কিন দূতাবাসের যে কয়েকজন কর্মী রয়েছেন তাদের জন্য কঠিন হবে। সারা দেশে ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ, নিরাপত্তা ঝুঁকি, ভাষার প্রতিবন্ধকতা এবং লোকস্বল্পতা এই কাজটিকে জটিল করে তুলবে।
এসব সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের মতো মার্কিন কর্মকর্তাদের শেষ পর্যন্ত সুশীল সমাজ, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করতে হবে। একই সময়ে মার্কিন দূতাবাসকে হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর অসংখ্য দাবি ও পাল্টা দাবি শুনতে হবে। এসব দাবির প্রত্যেকটিই হবে দলগুলোর নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মার্কিন পদক্ষেপকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে। কেরানীগঞ্জে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে যে পাল্টাপাল্টি দাবি দেখা গেছে, তাই প্রমাণ করে যে, কারও অপরাধ নির্ণয় করা কতোটা কঠিন হবে।
উপরন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আইনজীবী ও নীতিনির্ধারকরা আসলে কোন পর্যায়ের প্রমাণ চাইবেন এবং তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া কতোটা শ্রমঘন হবে তাও দেখতে হবে। আমলাতান্ত্রিক বাস্তবতার কথা বিবেচনা করলে, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত বিধিনিষেধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ বাছ-বিচার করবেন। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আগে নিশ্চিত করতে হবে যে, তার পেছনে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে এবং তা সংশ্লিষ্ট নীতি ও আইনের অধীনে পড়ে। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের নানা দাবির কারণে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেমন সময় লাগবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সর্বোপরি, মার্কিন এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কতোটা সফল হয়েছে তা মূল্যায়ন করতে হবে। এই ভিসা নীতি বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভালো নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতে অবদান রেখেছে কিনা তা দেখতে হবে। যারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে চাইবে, কেবল মার্কিন ভিসা প্রত্যাহার হয়তো তাদের বদলানোর জন্য যথেষ্ট হবে না। যদিও নিষেধাজ্ঞার হুমকি আসলে অত্যন্ত বাস্তব এবং নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও এতে আক্রান্ত হবেন।
এই নিষেধাজ্ঞা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে যদি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো সমমনা দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি অনুসরণ করে। নিষেধাজ্ঞায় পড়লে যাদের সব থেকে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে আছে নিরাপত্তা বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সিভিল সার্ভিস এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকে পছন্দ করবেন না। যদি এভাবে সরকার ও বিরোধীদের সমর্থন দেওয়া খুঁটিগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া যায় তাহলে প্রকৃত পরিবর্তনের সম্ভাবনা বাড়বে।
উপরে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারসাম্যের জন্য নতুন মার্কিন ভিসা নীতি একটি দারুণ পদক্ষেপ। এটি একটি ইঙ্গিত যে, এ ধরনের নির্বাচনের চক্র আর থাকবে না। এটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, বাইডেন প্রশাসন নয়াদিল্লির সম্ভাব্য প্রতিবাদ সত্ত্বেও তার নতুন নীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজের প্রতিবেশী দেশগুলোর বিষয়ে ভারতের অবস্থানকে সম্মান করে বলে বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন নীতির উপর অতীতে এক ধরনের ‘ভার্চ্যুয়াল ভেটো’ দিয়ে রাখতে পেরেছিল ভারত। যদিও বাইডেন প্রশাসন এখনও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তবে দেশটি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নিজের মতপার্থক্য নিয়ে ভারতের সঙ্গে আর কথা না বলার ইঙ্গিত দিয়েছে। এখন অন্য দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক অংশীদারদেরও বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে তাদের অঙ্গীকার প্রদর্শনের সময় এসেছে।