বৃক্ষ রোপণে পিছিয়ে থাকলেও কর্তনে এগিয়ে আমরা। প্রশাসনের কাছে বৃক্ষ রোপণের হিসাব থাকে; কিন্তু বৃক্ষনিধনের খবর থাকে না বা রাখেন না কেউ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বেশ তৎপর হয়ে পড়েন। বৃক্ষ রোপণ ও পরিবেশ সচেতনতার ব্যাপারে তখন খুব আন্তরিক দেখা যায় তাদের। এর ভেতরের রহস্য খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই আগ্রহের পেছনে রয়েছে টাকার খেলা; কিন্তু সেই সব বৃক্ষ কতদিন বেঁচে থাকল, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না তাদের। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বৃক্ষ রোপণ প্রজেক্টে মোটা অঙ্কের বাজেট আছে। এজন্য এ কাজে কর্তকর্তাদের তোড়জোড় দেখা যায়; কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে টাকার বরাদ্দ না থাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের সেখানে আগ্রহই থাকে না। একই ভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি পালন করলেও তা রক্ষণাবেক্ষণে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নানা ধরনের কর্মসূচি পালিত হয়। সভ্যতা, নগরায়ণ, শিল্পায়নের নামে প্রকৃতিকে যেভাবে নিঃশেষ করা হচ্ছে, তা দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চৈতালি’ কবিতার চরণটি মনে পড়ে যায়, তিনি বলেছিলেন, ‘দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর’। ‘আমাদের প্রকৃতি কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। প্রকৃতি শুধু আমার নয়, আমাদের। আমরা প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি আমাদের সবার। আসুন আমরা আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করি, আমরা নিজেদের রক্ষা করি। কেননা, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষা করা মানেই নিজেদেরকে রক্ষা করা। আমরা গাছ লাগাই। গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটু সবুজ অরণ্য রেখে যাই। বিশ্বকে বসবাসযোগ্য করে তুলতে সাহায্য করি।’
প্রতি বছর পরিবেশ দিবস কেন্দ্রিক নানা আলোচনা, উদ্যোগ, পরিকল্পনার পরও বনভূমি উজাড় কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে একের পর এক উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। অনেক বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কার মধ্যেই এগুলো করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি এবং কৃষিজমি ধ্বংসের অনেক উদাহরণ রয়েছে। সরকার ও বিভিন্ন দপ্তরকর্তৃক পরিবেশ নষ্ট করে নানা স্থাপনা তৈরি করার অভিযোগও রয়েছে অনেক সংগঠন ও পরিবেশকর্মীর বিরুদ্ধে।
পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বনভূমি থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বনভূমি সৃজন কষ্টসাধ্য। বর্তমানে দেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ মোট ভূমির ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং বন আচ্ছাদন ১৪ দশমিক ০১ শতাংশ। আশার কথা হলো—আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের বৃক্ষ আচ্ছাদন ২৫ শতাংশে এবং বন আচ্ছাদনের পরিমাণ মোট ভূমির ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে কাজ করছে সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে সারা দেশে ১ কোটি চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছিল। চারা রোপণের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা দরকার।
অন্যদিকে নিরাশার কথা হলো—পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত দেশের প্রায় ৩ লাখ একর বনভূমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এখন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গাছ কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ড্রেন, রাস্তা, ভবন নির্মাণসহ নানা স্থাপনা তৈরিতে নিধন হচ্ছে বৃক্ষ। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একইভাবে গাছ কাটার মহোৎসব চলছে। যশোরের অভয়নগর উপজেলার সিদ্দিপাশা ইউনিয়নে বিগত কয়েক বছর ধরে চলছে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কারখানা। প্রশাসনের অভিযানে কিছু দিন বন্ধ থাকার পর অদৃশ্য শক্তির ইশারায় আবারও চালু হয়ে যায় গাছ পুড়িয়ে কয়লা বানানোর তুঘলকি কাণ্ড। অপ্রয়োজনে বৃক্ষনিধন বন্ধ হোক। সবুজে ভরে উঠুক দেশ।