বর্ষার শুরুতেই ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে ভোলার তেঁতুলিয়া নদীতে। এতে করে সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া পাড়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার হুমকির মুখে রয়েছে। গত কয়েক বছরে ভাঙনে আরো প্রায় সহস্রাধিক পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। তবে ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী কোনো সমাধান না হওয়ায় তেঁতুলিয়া পাড়ের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী সমাধান তাদের দাবি। তা করা না হলে যেকোনো সময় ভোলার মানচিত্র থেকে ভেদুরিয়া ইউনিয়নটি বিলীন হয়ে যাবে। ক্ষতির মুখে পড়বে একটি গ্যাস কূপ, সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
গতকাল শুক্রবার (১ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভেদুরিয়া লঞ্চঘাট থেকে দক্ষিণে চর চটকিমারা খেয়াঘাট পর্যন্ত সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলছে। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি, বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙনে হুমকির মুখে রয়েছে একটি মডেল মসজিদ, দুটি বাজার, একটি গ্যাস কূপ, একটি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, লঞ্চঘাট ও কয়েক হাজার ঘড়বাড়ি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে ভোলা সদরের ভেদুরিয়া ইউনিয়নের লঞ্চঘাট, চর চটকিমারা ও মাঝিরহাট পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙন চললেও কোনো বাবস্থা নেয়া হয়নি। এতে বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙন থেকে রক্ষায় কয়েকবার মাববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও কোনো সুফল পায়নি এলাবাবাসী। এ বছরও শুরু হয়েছে ভাঙন। লঞ্চঘাট ও চর চটকিমারা পয়েন্ট দিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাঙছে বলে জানায় এলাকাবাসী।
ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য ভেদুরিয়া গ্রামের ৭৭ বছর বয়সী বৃদ্ধ আমিন উদ্দিন ঢ়ারী জানান, তেঁতুলিয়া নদীর গত কয়েক বছরের ভাঙনে তিন বার ভিটে হারিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ চার গণ্ডা জমি কিনে কোনরকম ঘর তুলে বসবাস করছেন। ছেলে সন্তান না থাকায় এখনও অন্যের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। বয়সের ভারে এখন ঠিকমতো কাজও করতে পারছেন না। এরই মধ্যে নদী ভাঙতে ভাঙতে ঘরের কাছে চলে এসেছে। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটে তার।
একই এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ কাদের মোল্লা জানান, তিনিও চারবার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ যে বাড়িটিতে আছেন সেটিও এখন ভাঙনের মুখে। এই বাড়িতে ১২টি ঘর ছিল। ভাঙনে ১০টি ঘর ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। এখন তার ঘরটিসহ মাত্র দুটি ঘর বাকি আছে। এবার ভাঙলে আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না।
স্থানীয় গৃহবধূ রেজমিন জানান, তার স্বামী নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। গত ৫ মাস আগে ভাঙনে তাদের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন অন্যের জমিতে এসে একটি ঘর তুলে বসবাস করছেন। সেটিও এখন হুমকির মুখে।
পাঁচবার ভাঙনের শিকার মো. মাহিদুল ইসালাম জানান, নদীতে বাপ-দাদার ভিটেমাটি নিয়ে গেছে। এখন নতুন করে চার ভাই মিলে অল্প একটু জায়গা কিনে বসবাস করছেন। সেই বাড়িটিও এখন অর্ধেক নদীতে নিয়ে গেছে। বাকি অর্ধেক নিয়ে গেলে রাস্তায় থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. মনজু ইসলাম জানান, তেঁতুলিয়া নদীর ভয়াবহ ভাঙনে ভেদুরিয়া ইউনিয়নের অনেক পরিবার পথে বসেছে। এখননো ভাঙন চলছে। গত বছর বর্ষা মৌসুমে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে যে জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলেছে সেগুলোও নদীর পেটে চলে গেছে। ভাঙনের কারণে ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটটি অন্তত ১০ বার সরানো হয়েছে।
এ বছর নতুন করে আবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। তেঁতুলিয়ার ভয়াবহ ভাঙনের ফলে এই এলাকার ৬৮ কোটি টাকা ব্যায়ে নবনির্মিত সরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, একটি গ্যাস কূপ, দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মডেল মসজিদসহ কয়েক হাজার ঘরবাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে। দ্রুত ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে ভেদুরিয়া ইউনিয়নটি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে। তাই ভাঙন প্রতিরোধে জিও ব্যাগ ও বøক বাধের জোর দাবি জানাচ্ছি।
ভেদুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল বলেন, তেঁতুলিয়া নদীর ভয়াবহ ভাঙনের ফলে ভেদুরিয়া ইউনিয়নের অনেক ঘরবাড়ি বিলিন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ হানানুজ্জামান জানান, গত মাসে তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ভাঙনের তীব্রতা বাড়লে জিও ব্যাগ ফালানো হবে। এছাড়াও ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী সমাধানের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। সেটি শেষ হলে তারা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠাবেন