রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য পট পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ সম্প্রতি এরকম আভাস দিয়েছেন যে, আলোচনা ও শান্তিচুক্তির জন্য প্রস্তুত রয়েছে ইউক্রেন। রেজনিকভকে বলতে শোনা গেছে, ‘রাশিয়া যদি যুদ্ধ-পূর্ব সময়ে ফিরে যায়, তথা বিশেষ সামরিক অভিযানের রাস্তা থেকে সরে আসে, তবে ইউক্রেন সেই উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে, শান্তি আলোচনার ক্ষেত্র অবারিত করতে কাজ করবে। গত ৮ জুন খেরসন পরিদর্শন করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। জাফোরাইজ অঞ্চলে সফর করে চলমান সংঘর্ষের হালনাগাদ খোঁজখবর নিয়েছেন তিনি। খেরসন পরিদর্শন শেষে জেলেনস্কির কাছ থেকে যে বিবৃতি এসেছে, তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় রেজনিকভের কথার। কিন্তু এই খবরে এখনই আপ্লুত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, যুদ্ধরত উভয় সেনাশিবিরকেই মারমুখী আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেনের সেনারা এই মার খাচ্ছে তো খানিক পরেই পালটা আঘাত হানছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীই কেবল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে—ব্যাপারটা এমনও নয়। বরং রাশিয়ান সেনারাও রয়েছে কঠিন চাপের মধ্যে। রুশ সেনাশিবিরেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহাত কম নয়। অর্থাৎ, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতা, চুক্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চললেও যুদ্ধবিরতি তথা রক্তপাত বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না!
ফ্রান্সের কাছ থেকে পাওয়া ইউক্রেনের শক্তিশালী এএমএক্স-১০এস ও ‘সম্মুখসারির যোদ্ধা’ হিসেবে অবিহিত জার্মান লেপার্ড এ-৬সহ বহু ইউক্রেনীয় ট্যাংক গুঁড়িয়ে দিয়েছে রুশ সেনারা। ধ্বংস করেছে ইউক্রেনের বহু প্রতিরক্ষা রাডার, যার মধ্যে রয়েছে টিআরএমএল-৪ডি-এইএসএর মতো অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। রুশ সেনাদের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে আইরিস-টি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মতো ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে চলমান সংঘাতে ইউক্রেনের সেনারা যে খুব একটা ভালো অবস্থায় রয়েছে, এমন কথা বলা যাবে না।
এই যুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারা কঠিন। কিন্তু রুশ সেনারা যে আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না, যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখেই তা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। বেসামরিক লোকজনের পাশাপাশি রুশ সেনাদের হতাহতের সংখ্যা কম নয়। অর্থাৎ, যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থাও ততটা ভালো নয়, যেমনটা মনে করে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
আমরা দেখেছি, স্বল্পমাত্রার হলেও পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে আসছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের সেনারা যেহেতু যুদ্ধে পুতিন বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে ধরাশায়ী করতে পারেনি এখন পর্যন্ত, সুতরাং ধরে নিতে হবে, সরবরাহকৃত অস্ত্রসরঞ্জাম তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এমনকি বলতে হয়, এসব অস্ত্র কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সফলতা বয়ে আনতে পারছে না। এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি জরুরি ইউক্রেনকে অধিক শক্তি ও সক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহ করা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ন্যাটো-প্রশিক্ষিত ৪৭তম ম্যাকানাইজড, নাইট ভিশন, থার্মাল ইমেজিং গিয়ার, ইউএস ব্র্যাডলিসহ সুসজ্জিত পদাতিক ফাইটিং ভেহিকেল ও বিপুল পরিমাণ আর্টিলারি দিয়ে ঘিরে রাখা হিমারসের মতো অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থার স্মরণাপন্ন হয়েও যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কায়দা করে উঠতে পারছে না ইউক্রেনের সেনারা। বরং বিভিন্ন ব্রিগেড তো বটেই, অন্যান্য শক্তিশালী ইউনিটও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে রুশ সেনাদের বুলেট-বোমার আঘাতে। এমনও ঘটতে দেখা গেছে, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া ইউক্রেনের অনেক ব্যাটালিয়ন যুদ্ধ করতে অস্বীকার পর্যন্ত করে বসেছে! এই অবস্থায় জেলেনস্কির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে, যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করতে গেলে কোন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দরকার এবং তা প্রাপ্তির উপায় কী?
জেলেনস্কির মতোই অবস্থা পুতিনেরও। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে লড়াই চালিয়েও এখন অবধি ইউক্রেন যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত জয়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেননি পুতিন। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ইউক্রেন দখল করে নেওয়ার যে বাসনা থেকে এই যুদ্ধ শুরু করেন তিনি, তা পূরণ করার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেননি। বরং যুদ্ধে হাজার হাজার সেনা হারিয়েছেন তিনি। এমনকি ইউক্রেনের সেনাদের ছোড়া বোমা আছড়ে পড়তে দেখা গেছে খোদ রাশিয়ার মাটিতে! এসব ঘটনা পুতিনকে যে আরামে ঘুমাতে দিচ্ছে না, এ কথা না মেনে উপায় নেই।
বলে রাখা দরকার, বহু রুশ সেনা ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও যোদ্ধাদের হাতে মারা পড়লেও রাশিয়ান জওয়ানদের লাইনটা বেশ লম্বা! এখনো বিশাল রিজার্ভ ফোর্স রয়েছে পুতিনের সেনাভান্ডারে। ধারণা করা হয়, নতুন করে লাখ দুয়েক সেনা ইউক্রেনের মাটিতে জড়ো করতে পারেন পুতিন। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কিছু করে সেনা মোতায়েন শুরুও করেছেন তিনি।
অর্থাৎ, পরিষ্কার কথা হলো, উভয় পক্ষেরই ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হলেও যুদ্ধে এখন পর্যন্ত সুবিধা করে উঠতে পারেনি কোনো পক্ষই। এই অবস্থায় প্রশ্ন হলো, এই যুদ্ধের শেষটা ঠিক কত দূরে? এই অবস্থায় শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও সমঝোতা, চুক্তি ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই বলে ধরে নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে বরং উদ্যোগ নিতে হবে উভয় পক্ষ থেকেই।
বাস্তবতা হলো, রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি বা সমঝোতা চুক্তির ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারেন না জেলেনস্কি—পারার কথাও নয়। কারণ, এতে করে নিশ্চিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর রোষানলে পড়বেন তিনি। এবং এতে করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ‘সুন্দর সম্পর্ক’ ধ্বংস হওয়ার ফলে ইউক্রেন আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।
এখন অবধি ক্রেমলিনের কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। হতে পারে রুশ কর্মকর্তারা রেজনিকভের কথার মানে বুঝতে পারছেন না এবং তার উদ্যোগে আলোচনা টেবিল পর্যন্ত আদৌ গড়াবে কি না, তা-ও বুঝতে চেষ্টা করছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে রেজনিকভকে বরখাস্ত করার কথা চিন্তা করেছিলেন জেলেনস্কি। এরপর রেজনিকভকে নিয়ে ইউক্রেনের ভেতরে-বাইরে নানান নোংরা গল্প ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু তারপর রহস্যজনকভাবে ক্ষমা পেয়ে যান তিনি! এ ঘটনার পর মনে করা হয়, জেলেনস্কি ও রেজনিকভের মধ্যে একধরনের টানাপড়েন চলছে। এরূপ পরিপ্রেক্ষিতে রেজনিকভের মুখ থেকে ‘শান্তি আলোচনা’র প্রস্তাব আসায় তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মস্কো।
আজকাল এমন অনেক প্রশ্ন উঠছে—জেলেনস্কি কি সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের ভয়ে রেজনিকভের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি? রেজনিকভের মুখ থেকে হঠাৎ আলোচনা-সমঝোতার কথাই-বা বেরিয়ে আসছে কেন? রেজনিকভ কি ইউক্রেনের বাকি সামরিক নেতাদের পক্ষে কথা বলছেন? কৌশলের অংশ হিসেবে রেজনিকভকে সামনে রেখে রাশিয়ানদের কি পরীক্ষা করছেন জেলেনস্কি? সত্যি বলতে, এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলানো যে কারও জন্যই বেশ কঠিন।
যা হোক, আলোচনা ও সমঝোতা চুক্তি ছাড়া এ যুদ্ধ বন্ধ হবে না কোনোভাবেই। শেষ বার দুই পক্ষের মধ্যে বেশ ভালো একটা আলোচনা হয়েছিল ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের উদ্যোগে—ইউক্রেন, রাশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্সকে দেখা গিয়েছিল আলোচনার টেবিলে।
ফিরে দেখার বিষয়, ১৯৬২ সালে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র-সংকটের সময়কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তার জাতীয় নিরাপত্তা দলকে পাশ কাটিয়ে নিজের ভাই রবার্ট কেনেডিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আনাতোলি ডব্রিনিনের সঙ্গে গোপন বৈঠকে পাঠান। রবার্ট কেনেডি তখন অ্যাটর্নি জেনারেল। এ ঘটনায় সে সময় বিভিন্ন পক্ষ থেকে বহু প্রশ্ন উঠতে থাকে।
এখন কথা হলো, রবার্ট কেনেডির মতো রেজনিকভও কি একই চরিত্রে অভিনয়ে নামার চেষ্টা করছেন? জেলনস্কি কি কেনেডির কৌশল অবলম্বন করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন? এক্ষেত্রে যাই ঘটুক না কেন, এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা থেকে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে রাশিয়া। ইউক্রেনের ঐক্য বিনষ্ট করার উপায় খুঁজে বের করতে চাইবেন পুতিন। তবে এর পরও বাস্তবসম্মত আলোচনা-সমঝোতার প্রশ্ন থেকেই যায়—যদি এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হয়। তা না হলে যুদ্ধ কেবল সামনের দিকেই গড়াতে থাকবে।