করোনার সময়ে মানুষ সবচেয়ে ভুগেছে অক্সিজেনসংকটে। মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায় গাছ কাটাও কমে যায়। ফলে প্রকৃতিতে বেড়ে যায় অক্সিজেনের সরবরাহ। পৃথিবী ভরে যায় সবুজে। কোভিড-১৯-এর অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার বন্ধ করে তার কাছে ফিরে যাওয়া। সহাবস্থান না করে অত্যাচার চালালে মানুষও যে টিকতে পারবে না, এটিই যেন বলে দিয়েছে করোনা মহামারি। সে কারণে পরিবেশ রক্ষা এবং সচেতনতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে, পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিকতার বিষয়টি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমাদের সমাজ রাজনীতি প্রভাবিত। রাজনীতি, অর্থনীতি, অপরাধসহ অন্য বিষয়ে সাংবাদিকতা যতটা গুরুত্ব পায় পরিবেশ সাংবাদিকতা ততটা পায় না। অথচ আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই পরিবেশ সাংবাদিকতার বিকাশ অত্যন্ত জরুরি।
প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে মানুষ তথা প্রাণিকুলের সঙ্গে সহাবস্থান করে কীভাবে একসঙ্গে চলে পরিবেশের আরো উন্নয়ন ঘটানো যায়, সেটিই পরিবেশ সাংবাদিকতার মূল কথা। রিপোর্ট, ফিচার, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় এমনকি ফটোগ্রাফিতেও পরিবেশ সংরক্ষণের ভারসাম্যের বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়া প্রয়োজন। পরিবেশ সাংবাদিকতা পরিবেশ আন্দোলনেরই শান্তিময় এক বাতাবরণ হতে পারে। বাংলাদেশে নদী-খালগুলোর দখলদূষণ বন্ধ না হওয়ায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দখল-দূষণের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান এবং সামান্য জেল-জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে সবকিছু। অথচ পরিবেশ সচেতনতার এই যুগে নদী-খালের দখল দূষণ বন্ধ এবং যথাযথভাবে তা রক্ষা করা সময়ের দাবি। ডায়িং বর্জ্য তুরাগ নদে ফেলে দূষণের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। জরিমানাও করা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু দূষণ বন্ধ হয় না। এসব বর্জ্যর মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক, পলিথিন, রাসায়নিক সামগ্রী, জৈব, অজৈব ও গৃহস্থালি বর্জ্য। শুধু তা-ই নয়, সাভার অঞ্চলের শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদী-খালে। গাজীপুরের অবস্থাও একই। সেখানকার জমিজমা পর্যন্ত চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে শিল্পবর্জ্যের দূষণে। এ অবস্থায় এতদঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগব্যাধি।
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সংকট আরো ঘনীভূত হবে। বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। অথচ মাত্র এক মিটার উচ্চতা বাড়লেই দেশের সাড়ে ১৭ ভাগ ভূমি সাগরতলে হারিয়ে যাবে চিরতরে! এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ বাংলাদেশ। সাগরতলে ভূমি হারিয়ে গেলে কয়েক কোটি লোক পরিবেশ আর জলবায়ু শরণার্থী হবে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে যে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনও সাগরকোলে তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হবে মারাত্মকভাবে। এ অবস্থায় টেকসই পরিবেশ বজায় রাখাই বিরাট চ্যালেঞ্জ।
পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, আর্সেনিক দূষণ, মাটিদূষণ আরো জটিল করে তুলছে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ সমস্যাকে। রাজধানী ঢাকা এখন নানা দিক থেকেই বাস অনুপযোগী শহর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় লোকজনকে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে। যত্রতত্র যখন-তখন খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ধুলার। সকালবেলা বাসাবাড়ি থেকে বের হয়ে লোকজনকে রীতিমতো ধুলায় গোসল করে ফিরতে হয়। ওয়াসা, ডেসা, তিতাস—এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে কাজ শেষ করে তো আরেক সংস্থা শুরু করে। এতে যেমন রাষ্ট্রের অর্থের শ্রাদ্ধ হয় তেমনি ভোগান্তিও বাড়ে। এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের কাজের কোনো সমন্বয় না থাকায় যুগ যুগ ধরে চলছে এই জগাখিচুড়ি অবস্থা।
মানুষের লোভ ও লালসা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনদিন। সর্বগ্রাসী মানসিকতার কাছে হার মানছে আইনকানুন মানবিকতা—সব। ফলে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের। প্রতিবছর পাহাড়ধসে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। ইতিপূর্বে চট্টগ্রামের ১২টি পাহাড়কে ভূমিধসের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সরকারিভাবে গঠিত তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও কক্সবাজার পৌরসভার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
পরিবেশদূষণের বিষয়টি ভয়াবহ। রাষ্ট্র ও সমাজের কেউই রেহাই পায় না। এই দূষণ রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যেও থাকে না। গোটা অঞ্চল তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গত ৩১ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট ও ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৩২ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী পরিবেশদূষণ। দূষণে প্রতি ১ লাখের মধ্যে ১৬৯টি শিশু অকালে মারা যায়। বাংলাদেশের প্রায় শত ভাগ মানুষ বেশির ভাগ সময় দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকে এবং পানিদূষণের কারণে ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা রোগ বাড়ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেশের চারটি অঞ্চলকে পরিবেশের দিক থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। এগুলো হলো যথাক্রমে বরেন্দ্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূল ও হাওর এলাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বিচার পাহাড় ও বন ধ্বংস করে নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। নদীর পানির প্রবাহ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ থাকতে হবে। হাওর অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা ফসল ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরিবেশের দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। প্রায় প্রতি বছর সেখানে ঘূর্ণিঝড় হানা দেয়। লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবিকাও মারাত্মক হুমকির মুখে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক তথ্য হলো পরিবেশদূষণ আমাদের উন্নয়নের গতিও থামিয়ে দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয় এবং পরিবেশদূষণে জিডিপির ৮ শতাংশ খোয়া যায়। পরিবেশদূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সব উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশ সহায়ক। উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ বন, নদী, জলাভূমি, সৈকত ধ্বংস করা যাবে না। শিল্পকারখানা করার ক্ষেত্রে পরিবেশ আইন শতভাগ মেনে চলতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ৬ষ্ঠ স্থানে। তাপমাত্রা ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে দেশে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। পালটে যাচ্ছে ঋতুর ধারাক্রম। ফলে মানুষের চিরচেনা স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহই আজ ব্যাহত। এ কারণে প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণিকুলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিকতা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। লেখার মাধ্যমে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশবাদী সংগঠন নিয়ে বেশি করে খবর প্রকাশ করতে হবে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। পরিবেশসংক্রান্ত আইনকানুন নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাও পরিবেশ সাংবাদিকতার অংশ। পরিবেশ মন্ত্রণালয় আছে, আছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের কার্যক্রম নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশ সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি ও পরিধি বাড়াতে হবে।