সম্প্রতি একটি ঘটনা আমার মনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। দেখলাম, একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ পুড়িয়ে প্রতিবাদ করছে। সত্যিকার জ্ঞানার্জন করলে সনদ পোড়ানোর দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো শিক্ষালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে শিক্ষিত বিবেক তৈরি করা। প্রকৃত শিক্ষার উপজাত হিসেবে জীবিকা সৃষ্টি হবেই।
বর্তমান সময়ে সনদের চেয়ে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কাজের দক্ষতা বা নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম ‘এইচএসসি পাশের আগেই এমআইটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে নাফিসও অবাক’। খবরে প্রকাশ চাঁদপুর সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত নাফিস উল হক ওরফে সিফাত। এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগেই সিফাত বিশ্বের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে স্নাতকে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এর নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণিত অলিম্পিয়াডসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নাফিস ছিলেন নিয়মিত মুখ। আছে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। ঘটনাটি গণিতের জাদুকরি শক্তির জানান দিচ্ছে। সেই গণিত শিক্ষাতেই আমরা সার্বিকভাবে পিছিয়ে আছি।
১৮ জুন ২০২৩, জাতীয় দৈনিকে ‘বিনিয়োগ বেশি সুফল কম’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরে প্রকাশ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় গত কয়েক বছরে বিপুল বিনিয়োগ করেছে সরকার। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে শিক্ষকদের বেতনভাতা ও মর্যাদা। এর পরও বিভিন্ন জরিপে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ শিখনমানে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দায়িত্ব পালনে প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষকরা সফল নন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ের পরিদর্শনেও আছে দায়িত্ব অবহেলা।
সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘নাগরিক কর্তৃক মূল্যায়ন’ শীর্ষক একটি জরিপ করা হয়। কোনো না কোনো সময় বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৭৫১ ছেলে ও ৭৮২ মেয়ে শিশুর ওপর জরিপটি করা হয়েছে। তবে এটি বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার্থীদের জরিপ নয়। পাঁচ থেকে ১৬ বছর বয়সি প্রান্তিক শিশুদের বাড়িতে গিয়ে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়। জরিপে দেখা যায় গণিতে একক অঙ্ক শনাক্ত করতে পারেনি ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ ছেলে এবং ১৩ শতাংশ মেয়ে। আর ভাগ করতে পারেনি প্রায় ৯৬ শতাংশ ছেলে এবং ৯৭ শতাংশের বেশি মেয়ে।
বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় কোনো একটি বছরে ৮৫ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ হাজার পরীক্ষার্থী গণিত বিষয়ে উত্তরই দেয়নি। ৫০ হাজার পরীক্ষার্থী গণিত বিষয়ে উত্তর দিলেও ২৫ নম্বরের মধ্যে ৭ বা ৭-এর বেশি পেয়েছে প্রায় ১৩ হাজার জন। ১০ বা ১০-এর বেশি পেয়েছে প্রায় ৪ হাজার জন। ১৫ বা ১৫-এর বেশি পেয়েছে ২৫০ জন। আর ২০ বা ২০-এর ওপরে নম্বর পেয়েছে ১০ জন। অনুরূপ পরীক্ষায় অন্য একটি বছরে বিকল্প বিষয়ে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না থাকায় প্রায় ৭৬ হাজার জন অঙ্ক বিষয়ে উত্তর দিয়েছে। এই পরীক্ষায় প্রায় ১৫ হাজার জন ২৫ নম্বরের মধ্যে ৭ বা ৭-এর বেশি পেয়েছে। ১০ বা ১০-এর বেশি প্রায় ৫ হাজার জন। ১৫ বা ১৫-এর বেশি পেয়েছে প্রায় ৯০০ জন। ২০ বা ২০-এর বেশি নম্বর পেয়েছে প্রায় ৯০ জন। মেধাবীদের এমন হতাশাব্যঞ্জক গণিতের ফলাফল গবেষণাপ্রেমী আগামীর স্মার্ট নাগরিক তৈরির অন্তরায়।
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ৩৪টি দেশে জরিপ চালিয়ে দেখেছে ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সি ৩১ শতাংশ কিশোর-কিশোরী গণিত নিয়ে ভীষণ উদ্বেগে ভোগে। গবেষণা বলছে, ‘অঙ্কের ফলাফল হয় ঠিক হবে, না হলে ভুল। এখানে অন্য কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর সুযোগ নেই। এজন্য অঙ্ক করার আগেই মানুষ সেটা ভুল হওয়ার আশঙ্কায় থাকেন।’ নিউ ইয়র্কের বার্নাড কলেজের সভাপতি এবং কগনিটিভ বিজ্ঞানী সিয়ন বেইলক বলেছেন, ‘যেহেতু আমাদের মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা সীমিত। যখন আমাদের মস্তিষ্ক একসঙ্গে একাধিক কাজ করে, তখন আমাদের মনোযোগ বিভক্ত হয়ে যায়, তাই আপনি যদি গণিত নিয়ে উদ্বিগ্ন হন তখন আপনার মাথায় একটা কথাই ঘুরতে থাকে, আপনি পারবেন না। যা গণিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।’
মনোবিজ্ঞানীরা প্রায়শই অ্যাভার্সন থেরাপির মাধ্যমে উদ্বেগের চিকিৎসা করেন—যেখানে আপনাকে প্রতিটি ভয়ের মুখোমুখি করে, সেই উদ্বেগ মোকাবিলা করতে শেখানো হয়। তবে গণিতের ভয় কাটাতে এই পদ্ধতি কাজে নাও দিতে পারে বলে জানিয়েছেন মনোবিজ্ঞানীরা। এক্ষেত্রে ‘এক্সপ্রেসিভ রাইটিং’ পদ্ধতি একটি উপায় হতে পারে। ‘এক্সপ্রেসিভ রাইটিং’ হলো গণিত নিয়ে ভয় ও উদ্বেগের কথা খাতায় বা ডায়ারিতে লিখে প্রকাশ করা। এর ফলে ওয়ার্কিং মেমোরিতে চাপ কমে, ফলে ভয় অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়গুলোর মতো গণিতের বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে কোনো অবস্থাতেই গণিতকে অনেক কঠিন বিষয়, সবাই গণিত পারে না, এসব বলে ভয় দেখানো যাবে না। গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে হিসাবের সময় ক্যালকুলেটরের ব্যবহার বর্জনীয়। অঙ্কের ভীতি দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত অনুশীলন। নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে গণিত বিভাগে অধ্যয়নরত আইনার স্কালভিক বলেছেন, গণিতের ভীতি কাটাতে সব শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মন খুলে কথা বলা বা প্রশ্ন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শুধু পাঠ্যবইকেন্দ্রিক না করে ধাঁধা, কুইজ, সুডোকু, পুলসাইড পাজল, দাবা, বোর্ড গেম, রুবিকস কিউব বা গণিতের নানা ধরনের অনলাইন খেলার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। এসব খেলা মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে তোলে।
১৯৫৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পাওয়া আন্তর্জাতিক গণিত প্রতিযোগিতার তালিকার দিকে নজর দিলে দেখব এ পর্যন্ত রাশিয়া ১৬ বার, চীন ২৩ বার ও আমেরিকা ৮ বার গণিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এর প্রভাব আমরা কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে দেখতে পাই। চীন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে ১ম, রাশিয়া ২য় এবং আমেরিকা ২৮তম। আমাদের অঙ্কের উৎকর্ষসাধনে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের স্কুল-কলেজের অঙ্কের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা যেতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা পরিবারের সঠিক শিক্ষাদর্শন ও বাস্তবায়নের আন্তরিকতাই শিক্ষাকে পরিণত করবে সমৃদ্ধির গুপ্তধনে।