মানুষের সৃষ্ট কাজের মাধ্যমে মানুষ এ পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সে কারণেই আজ বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি ও কষ্ট। খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এ কষ্টটা একটু বেশি। এ সমস্যা উত্তরণে বিশ্ব নেতাদের পাশাপাশি আমাদেরও অনেক সচেতন হতে হবে, অনেক কিছু বর্জন করতে হবে এবং অনেক কাজ করতে হবে। প্রথমে আসা যাক, বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে, এখন সেগুলোর ওপর আলোকপাত করা যাক।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি :প্রথমেই বলতে হয় গ্রিন হাউজ গ্যাসের কথা। গ্রিন হাউজ গ্যাসসমূহ সূর্যের অতিরিক্ত তাপ—যেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরণের মাধ্যমে ফিরে আসে, সেগুলোকে ট্র্যাপ করে এবং শোষণ করে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গ্রিন হাউজ গ্যাস, যেমন :ওয়াটার ভেপার (H2O), ওজোন (O3), কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), হাউড্রোফ্লোরো কার্বনস (HFCs), পারফ্লোরো কার্বনস (PFCs), সালফার হেক্সাফ্লোরাইড (SF4), নাইট্রোজেন ট্রাইফ্লোরাইড (NF3), ক্লোরোফ্লোরো কার্বনস (CFCs), ইত্যাদি এসব গ্যাসসমূহ নিঃসারণ হয় পরিবহন খাত, রেফ্রিজারেটর, শীতলীকরণ, বিদ্যুত্ উৎপাদন, শিল্প-কলকারখানায় ব্যবহূত কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি থেকে।
পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে পরিবহনে, বিদ্যুত্ উৎপাদনে, শিল্প-কারখানায় ও গৃহস্থালির কাজে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ ও দীর্ঘকালীন ইরাকে যুদ্ধ, ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিন ও হিজবুল্লাহর যুদ্ধ এবং ঐসব যুদ্ধে ব্যবহূত বিস্ফোরক ও জীবাশ্ম জ্বালানি বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রাজিলের আমাজান বনে আগুন, আফ্রিকায় বনভূমি উজাড়করণ, অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে আগুন, এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে মালেশিয়ায় ও ইন্দোনেশিয়ায় পাহাড়ি বনে আগুন, বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ও ব্যাপক মাত্রায় বন উজাড়; বিদ্যুত্ উত্পাদন, ইটের ভাটা ও অন্যান্য কাজে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
বাংলাদেশেও পরিবহন খাত, বিদ্যুত্ উৎপাদন খাত, শিল্প খাত, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতসমূহ থেকে গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপাদিত হয়। এছাড়া সিগারেটের কালো ধোয়া থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড, রেফ্রিজারেটর থেকে সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন) উৎপাদন হয়। বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবহূত জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন : পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি থেকে বাংলাদেশে গ্রিন হাউজ গ্যাসের সিংহভাগ উৎপাদিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়ত বৃক্ষনিধন প্রকাশ্যে এবং নীরবে ও নিভৃতে চলছে। এ অপরিণামদর্শী কাজ এশিয়ার দেশগুলোতে এবং বাংলাদেশেও চলছে। যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হচ্ছে, তার পুরোটা বৃক্ষরাজি, বন-বনানী, গুল্ম, লতাপাতা ও সামুদ্রিক শৈবাল কর্তৃক শোষণ হচ্ছে না। এ অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে থেকে যাচ্ছে এবং সূর্যের তাপকে শোষণ করে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশের ইটভাটায় কাঠ ব্যবহার এবং ইটভাটা থেকে ফ্লাইঅ্যাশ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ফ্লাইঅ্যাশ বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্র কণা যোগ করে থাকে, যা বায়ুদূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে।
এশিয়ার অনেক দেশে জলে নিমজ্জিত করে ধানচাষ করা হয়। বাংলাদেশেও এরূপ জলে নিমজ্জন ধানচাষ (Submerged Rice Cultivation) করা হয়ে থাকে; যার ফলে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস উৎপাদিত হয়ে থাকে, যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পাহাড় ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের বৃক্ষরাজি, লতাপাতা, পশুপাখি, অণুজীব এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়। যারফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ কমে যায়। প্রকারান্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় নগরীগুলোতে যানজট দেখা যায়। যানজটের কারণে গাড়িগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি অধিক পরিমাণে ব্যয়িত হয় এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য দূষিত গ্যাস নির্গত হয়। দেশে শিল্প-কলকারখানা থেকেও কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউজ গ্যাস, বর্জ্য এবং দূষক নির্গত ও উৎপাদিত হয় ও পরিবেশে মেশে। তাছাড়া শিল্প-কলকারখানা থেকে পণ্য তৈরি করার সময় গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গত হয়, যা পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।
পরিবেশ উন্নয়নে পদক্ষেপ :বিশ্ব ও বাংলাদেশের উষ্ণতা কমাতে গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপাদন কমাতে হবে। এজন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ুচালিত শক্তি, বায়োগ্যাসের ব্যবহার ও সোলার এনার্জির ব্যবহারের মাত্রা বাড়াতে হবে।
অনেক দেশে ট্রাফিক জ্যাম আছে এবং পুরোনো গাড়ি ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশেও বেশি দিনের পুরোনো গাড়ির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং ট্রাফিক জ্যাম কমাতে হবে। ঢাকা শহরের ট্রাফিকের অধিকাংশই উত্তর-দক্ষিণমুখী প্রবাহ; যদি পূর্ব-পশ্চিমমুখী আর একটা বড় প্রবাহ (ফ্লো) তৈরি করা যায়, তাহলে যানজট নিঃসন্দেহে কমতে পারে। যানজট নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মানুষকে ট্রাফিক এডুকেশন দ্বারা সচেতন করতে হবে, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে ও প্রেষণা দিতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বৃক্ষকর্তন নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে অধিক মনিটরিং ও সুপারভিশন দরকার। আইন প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। এ কাজে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিবেশ পুলিশ তৈরি করলে তারা এক্ষেত্রে সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বৃহদাকার বৃক্ষ কেটে ছোট ছোট বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে; যা ঐ বৃহৎ বৃক্ষের তুলনায় কম পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ বা গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে বর্জ্যসমূহ সমুদ্রের পানি দূষণ করছে এবং সামুদ্রিক শৈবালও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এজন্য পাহাড় ও পাহাড়ি বন-বনানী রক্ষার্থে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষরোপণ করা জরুরি।
জলাভূমিকে বলা হয়ে থাকে পরিবেশের রক্ত (Blood)। অথচ আমাদের জলাভূমিসমূহ দিনদিন ভরাট হচ্ছে, বিলুপ্তি ঘটছে। কিছু অসাধু লোক এগুলোতে বিভিন্ন রকম স্থাপনা, বিনোদন কেন্দ্র, খামার ও খামারবাড়ি তৈরি করছে। যার ফলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। জলাভূমির রক্ষার মাধ্যমে, বর্ষাকালের বৃষ্টির পানি, উজানের পানি, আন্তর্জাতিক নদী বা অন্য দেশের ওপর দিয়ে আসা পানিকে ধরে রাখা ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ফলে পরিবেশের উষ্ণতা কমানো যেতে পারে।
পরিকল্পিত নগরায়ণ :অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নিচুভূমি ও জলাভূমিকে উন্নয়ন করে নগরায়ণের পরিকল্পনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এর ফলে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি ও ওয়াটার টেবিল ধ্বংস হচ্ছে, যা পানির ঘাটতি তৈরি করে থাকে। পানির সংরক্ষণ বা ধরে রাখার জায়গা নষ্ট হলে পরিবেশের উষ্ণতার ওপর এর প্রভাব পড়বে। কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোন ধরনের গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপাদন করছে, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। সেজন্য শিল্পের ওপর মনিটরিং ও তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধবভাবে চলছে না, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। এছাড়া অপরিকল্পিত ব্যারেজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করার কারণে অনেক নদী-খাল ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো আর পানি ধরে রাখতে পারে না। ঐগুলো ড্রেজিং করে নাব্য ও গভীরতা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। অপরিকল্পিত ব্যারেজ, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভাট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে এবং সমন্বিতভাবে বিভিন্ন দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে।
পৃথিবীব্যাপী বৃক্ষনিধন বন্ধ করে ব্যাপক মাত্রায় বনায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে বনায়ন, সামাজিক বনায়ন, পারিবারিক বনায়ন, ছাদকৃষি, আঙিনাকৃষি ও সব পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যার ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ বৃদ্ধি পাবে ও তাপমাত্রা কমে আসবে।
বর্তমানে বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেজন্য প্রাকৃতিক কারণ যদিও কিছু রয়েছে কিন্তু মানবসৃষ্ট কারণই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের নেতাদের এবং নীতিনির্ধারকদের আরো সতর্ক, সচেতন হতে হবে। সর্বোপরি সবার পরিবেশকে ভালোবাসতে হবে। তাহলেই বৈশ্বিক উষ্ণতা কমবে এবং আমরা একটি সবুজ পরিবেশ ফিরে পাব।