১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনের ২০ দিন পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পাহাড়ি প্রতিনিধিদল স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের ক্ষমতাসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের এক দাবি তুলে ধরেন। যখন সামগ্রিকভাবে দেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নানান জটিলতার আবর্তে প্রায় দিশেহারা। বঙ্গবন্ধুকে কোনোরূপ সময় না দিয়ে এবং তার রাঙ্গামাটিতে প্রদত্ত ভাষণকে আমলে না নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পূর্বপ্রস্তুতিকে বেগবান করেন, যার প্রস্তুতি তিনি অবশ্যই স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় থেকেই নিচ্ছিলেন। রাজাকার বাহিনীতে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যাপক অংশগ্রহণ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং অস্ত্র সংগ্রহ তখন থেকেই নিচ্ছিলেন, যা পরে শান্তিবাহিনী নামে আত্মপ্রকাশ করে।
এম এন লারমা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মডেলকে পুরোপুরি অনুসরণ করে আশা করছিলেন, ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বেরিয়ে একটা স্বাধীন জুম্মল্যান্ড তৈরি করে শত বছর আগের হারানো চাকমা রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। তা করতে না পারলেও ১৯৪৭-এর ভারত অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করা।
তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সামরিকভাবে দুর্বল, অভ্যন্তরীণ নানান দুর্বলতায় জর্জরিত :সর্বহারা, জাসদসহ নানান রাজনৈতিক বিভাজনে ব্যতিব্যস্ত। এরকম লেজেগোবরে অবস্থায় একটু টোকা দিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম টুপ করে ম্যাপ থেকে আাালাদা হয়ে যাবে। তিনি ধরনা দিলেন মহামতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে, সামরিক সাহায্য চাইলেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে ফেলতে।
ইন্দিরা গান্ধী সে কথা তো কানে নিলেনই না, উপরন্তু বঙ্গবন্ধুকে ঘরের শত্রু বিভীষণের তৎপরতার কথা জানিয়ে দেন। পরে অবশ্য ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়।
দিল্লিতে ডাক পান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও সন্তুলারমা। তারপর ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝিতে ভারত থেকে অস্ত্রের প্রথম চালান আসে। ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকেই শান্তিবাহিনী সামরিক অ্যাকশনে নেমে পড়ে। প্রথম দিকে তাদের কর্মসূচি ছিল থানা আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা। পরবর্তী সময়ে নাশকতামূলক কাজ যেমন—পুল-কালভার্ট ধ্বংস করা, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়, প্রয়োজনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর ওপর ঝটিকা আক্রমণ করা। শান্তিবাহিনীর প্রথম দিকের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোর মধ্যে চাইনিজ বা চেকোস্লোভাকিয়ার তৈরি অস্ত্র খুবই কম ছিল। আরপিজি, হেভি মেশিনগান, মর্টার বা আক্রমণাত্মক অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়নি। শান্তিবাহিনীর রণকৌশল ছিল খুবই রক্ষণাত্মক। এবং বেসামরিক টার্গেটনির্ভর। বেসামরিক লোক থেকে শুরু করে থানা ও প্রশাসনের ওপর আক্রমণ পর্যন্ত।
শান্তিবাহিনী তার ২৩ বছরের সাংঘর্ষিক ইতিহাসে কখনোই প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে উওীর্ণ হতে পারেনি। শান্তিবাহিনীর মিত্ররা কখনোই শান্তিবাহিনীকে কোনো মারাত্মক আক্রমণাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত করেনি। পরিসংখ্যান বলে, শান্তিবাহিনী কখনোই সেনাবাহিনীর কোনো পোস্ট বা ক্যাম্প দখলে নিতে পারেনি বা তাকে অবরোধের মধ্যে ফেলে ক্যাম্প ছেড়ে যেতে বাধ্য করতে পারেনি।
শান্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোই শুধু দেশের অভ্যন্তরে ছিল, যা তারা সময়ে সময়ে নিরাপওার খাতিরেই পরিবর্তন করত। এসব ক্যাম্পে গেরিলাদের জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টকর। জোঁক, সাপ, পোকামাকড়, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়াসহ যাবতীয় রোগ মোকাবিলা না করতে পেরে অনেকেই দল ছেড়ে চলে যেত। তাছাড়া প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার মানসিক চাপ, কঠিন নিয়মশৃঙ্খলা মানা অনেকের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠায় প্রচুর দলত্যাগের ঘটনা ঘটত। একসময় শান্তিবাহিনীর সংখ্যা ৮ হাজারের ঘরে ঠাঁই পেয়েছিল। নেতৃত্বের কন্দোল ও জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় তা একসময় অর্ধেকে নেমে আসে।
শান্তিবাহিনীর জন্য জুতসই নিরাপদ অস্থায়ী ক্যাম্প পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে, যখন পার্টি বিভক্ত হয়। তারা অনেক সময় বহু আগে পরিত্যক্ত ক্যাম্প বা আস্তানায় আবার ফিরে যায়। কারণ রণকৌশলগতভাবে সব বিষয় মানা যায় এমন স্থান পাওয়া অত সহজ নয়।
দলগতভাবে শান্তিবাহিনীর কেউ পাড়ায় রাতযাপন করে না। কারণ পাড়ার সব লোক বিশ্বস্ত নয়। সাধারণভাবে তারা ত্রিপুরা বা মারমাপাড়ায় অবস্থান করে না। দলনেতার জাত যে জাতিসত্তার, তিনি সেই রকম পাড়াতেই অবস্থান করেন। ত্রিপুরাদের আর্থিক সংগতি কম বিধায় তারা কোনো ত্রিপুরাপাড়ায় খাবার বা আশ্রয় খোঁজেন না। রাতযাপনের জন্য পরিত্যক্ত জুমঘর বা খোলা আকাশের নিচে পলিথিন ব্যবহার করে। এদের প্রত্যকের কাছে এক টুকরো নীল পলিথিন থাকে।
শান্তিবাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রতি জনগণের কোনো ওৎসুক্যকে প্রশ্রয় দেয় না। তাদের কোনো প্রশ্ন করা বা কোথায় যাবেন, কোথা থেকে এসেছেন—এসব প্রশ্ন করাকে দারুণ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে।
শান্তিবাহিনী তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের শুরুতে দারুণ এবং একক জনপ্রিয়তা ও আনুকূল্য পেয়েছে। দলনেতাদের কথায় বিশ্বাস করেছে—পাহাড় খুব দ্রুত স্বাধীন হয়ে যাবে। কোনো বাঙালি থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৯৮৩ সালে পার্টি বিভাজিত হলে সাধারণ মানুষ দারুণ হতাশাগ্রস্ত হয়।
জনগণের এই হতাশা দূর করার জন্য এবং জেএসএস তাদের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য বাঙালিপাড়ায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন বাঙালি পাড়াগুলো বিভিন্ন জায়গায় অরক্ষিত বা নিরাপত্তাবলয়ের বাইরে ছিল বলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
আজ কেএনএফের কর্মকাণ্ডও তাদের বড় জ্ঞাতিভাই চাকমাদের অনুরূপ।
কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, তারা পাহাড়ে সফ্ট টার্গেট সড়ক নির্মাণকাজে রত শ্রমিকদের অপহরণ করছে। ঠিক এমনটাই জেএসএস করত। কুকিরা আজ পাহাড়ে চাকমাদের মতো বড়ভাই সেজে বসে আছে। তারা চাইছে এখান থেকে সব বম বা অন্যদের মিজোরামে নিয়ে গিয়ে একটা শরণার্থী ইস্যু তৈরি করতে। মিয়ানমার থেকে বার্মা সেনাদের তৎপরতার কারণে যেসব জনজাতি ভারতে এসেছে এবং মিজোরাম সরকার তাদের শরণার্থী শিবিরে স্থান দিয়েছে, কেএনএফ আজ তেমনটা চাইছে। রুমা, থানচি বা বান্দরবানের এই এলাকায় তেমন বড় বাঙালি বসতি না থাকায় তারা এখনই কোনো ব্যাপক বাঙালি নিধনে যাচ্ছে না। তবে পাহাড়ের নতুন সূর্য ‘পর্যটন’-এর আলোকে সন্ত্রাস দিয়ে ঢেকে দিতে বদ্ধপরিকর। ভবিষ্যতে বাঙালি ভ্রমণকারীদের ওপর আক্রমণ করে সবার টনক নাড়িয়ে দিতে চায় কেএনএফ।
৬. ভবিষ্যতে আমরা বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা দেখতে পারি কেএনএফের দিক থেকে। যেমন—নারী-শিশুসহ সপরিবারে কোনো পর্যটকবাহী গাড়িতে আক্রমণ ও অপহরণ।
আজকের কেএনএফের সদস্যরা বেশ লেখাপড়া জানা এবং স্মার্ট প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। ইন্টারনেটে সহজলভ্য অন্য জাতির ট্রেনিং ভিডিও বা প্রোপাগান্ডা ভিডিও তাদের জঙ্গলে বসেই অনেক কিছু জানতে সহায়তা করে।
কেএনএফের সদস্যদের গড় বয়স ২২-২৩। এই বয়সে একটা একে-৪৭ রাইফেল হাতে থাকলে নিজেকে দারুণ শক্তিশালী মনে হয়। তার ওপর ‘জাতির জন্য লড়াই করছি’—এই চেতনাবোধ একজন ‘চাকরিরত সৈনিকের’ মানসিকতাকে ছাড়িয়ে যায়।
নিজের ভূমিতে আধুনিক অস্ত্র সংবলিত এবং ‘জাতিবোধে’ উদ্বুদ্ধ তরুণ খুবই মারাত্মক।
কেএনএফের বর্তমান সদস্যদের সিংহভাগই বাংলাদেশের নাগরিক নয়। তারা মিয়ানমার ও ভারতের বৃহত্তর কুকিচিন গোষ্ঠীর। এদের মধ্যে শিক্ষার হার অত্যন্ত বেশি হওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে তারা জুতসই চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ায় বা সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকটা হতাশাগ্রস্ত। আর এটাই তাদের রিক্রুটমেন্টের হাই সেলিং পয়েন্ট।
কেএনএফ ব্যবহূত অস্ত্র-সরঞ্জাম-পোশাকের সঙ্গে মিয়ানমারভিত্তিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এদের ব্যবহূত অস্ত্রের মধ্যে গাদা বন্ধুক, কয়েকটি অটোমেটিক একে-৪৭ আছে বলে প্রমাণ মেলে। এদের অবস্থানগুলোর চারপাশে ক্রল ট্রেঞ্চ, ওভারহেড প্রটেকশন-সমৃদ্ধ বাংকার বলে দেয় তারা ‘স্ট্যান্ড অ্যান্ড ফাইট’ করার মতো মনোবলসম্পন্ন। এটা অনুমেয় হয় যে এদের অবস্থানের চারপাশে মাইন পুঁতে রাখে, যা রাখাইন ও আরাকান রাজ্যের মিয়ানমার সাময়িক জান্তা ট্যাকটিস ফলো করে। তাদের এসব কৌশলের শিকার হচ্ছে সেনাবাহিনীর টহল ও তাদের সঙ্গে থাকা পাহাড়ি গাইড। স্থানীয় পাহাড়িদের কেউ এসব মাইনে হতাহত হলে তারা এর ভয়াবহতাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে একটা ভীতি ছড়াতে চায়। থানচি, রোয়াংছড়ি, রুমা—এসব এলাকা রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ির মতো অতটা ঘনবসতিপূর্ণ না হওয়ায় মাইন পোঁতার তথ্য প্রায় সময়ই জনগণের মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পৌঁছায় না। তবে মাইন পোঁতার কৌশল কুকিদের ঐতিহ্যগত ফাঁদ পাতার কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়। কুকিরা স্নাইপার রাইফেলের ওপরে দক্ষ। কেএনএফ যে পর্যায়ে বর্তমানে প্রতিরোধ করছে, তা খুবই অকল্পনীয় এবং শান্তিবাহিনীর প্রতিরোধ বা আক্রমণের ধারা থেকে ভিন্ন।