মনে আছে কি, শীতলক্ষ্যায় গরু বোঝাই ট্রলারডুবির কথা? পত্রিকার পাতায় ছাপা হতো ট্রলারে করে কোরবানির গরুর হাটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গরু। সে কী দুর্ভোগ! দৃশ্যপট বদলে গেছে এবারের কোরবানির ঈদের গরু ঢাকায় আনার। ট্রলারের গরু এখন ট্রাকে চড়ে দ্রুত চলে আসছে ঢাকায়।
পত্রিকাগুলোর খবরচিত্রও বদলে গেছে। সময় নিউজ অনলাইনে সচিত্র সংবাদ দেখলাম, পদ্মা সেতু দিয়ে গরুর ট্রাক ঢুকছে ঢাকার গরুর হাটে। মহাখুশি গরুর পাইকাররা। ট্রলারে বসে দিন-দুই কাটাতে হচ্ছে না তাদের। ট্রলারডুবির সেই আশঙ্কাও এখন স্মৃতির পাতায়।
বরিশাল থেকে ঢাকা আসতে ৮-৯ ঘণ্টার পরিবর্তে সময় লাগে মাত্র তিন ঘণ্টা। ইচ্ছা করলে সকালের নাস্তা খাওয়া যায় বরিশাল থেকে ঢাকায় পৌঁছে। সবজি-মাছ ঢাকায় নিয়ে আসছে বৃহত্তর ফরিদপুর, বৃহত্তর বরিশাল এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষ।
মোংলা বন্দর ও পায়রা বন্দরে প্রাণচাঞ্চল্য এসেছে পদ্মা সেতুর কারণে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সঙ্গে বন্দরগুলোকেও করা হয়েছে আগের চেয়ে উন্নত। শুধু মোংলা বন্দরেই বছরে ১ হাজার ৫০০টি জাহাজ এবং প্রায় ১ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা লাভ করেছে, যা ২০২৫ সালে ৩ হাজারে পৌঁছাবে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছে। মিটমিট করে চলা বন্দরটিতে প্রাণের ছোঁয়া লেগেছে যেন।
এর সুফল পেতে শুরু করেছে আমাদের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকার কারণে যে আর্থিক ক্ষতি গুণতে হতো আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সেই দুর্ভোগ কমতে শুরু করেছে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দুর্ভোগ কমছে সাধারণ যাত্রীদেরও। পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা ও পায়রা বন্দরের গুরুত্ব বেড়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর আগ্রহের কারণেও।
গত ২২ মার্চ ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর হয় দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রীর নেতৃত্বে। সেই চুক্তি বলে ভুটান বাংলাদেশ থেকে ট্রানজিট সুবিধা লাভ করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই ট্রানজিট সুবিধার অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিল পদ্মা সেতুভিত্তিক যোগাযোগ সুবিধা। আর সেই চুক্তিতে অন্যান্য বন্দরের মতো মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি পণ্য আনা-নেওয়ার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা আরো বাড়বে সড়ক ও রেল যোগাযোগ উন্নয়নের কারণে। এখন কয়েক শ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় দেশটিতে। এটি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি আছে ট্রানজিট সুবিধার। পদ্মা সেতু হওয়ার সুবাদে তাদের পণ্য পরিবহনে মোংলা বন্দরকে ব্যবহারে তারা অধিকতর উত্সাহী হওয়ায় এখানেও বাংলাদেশের অর্জন ইতিবাচক। দেশের অর্থনৈতিক করিডর ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ের ওপর চাপ কমতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চল হাইওয়ে কার্যকর হওয়ার পর থেকে। ঢাকা-মোংলা-পায়রা ও বেনাপল স্থলবন্দর এখন একসুতায় গাঁথা। এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় এই পথ। পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকার সঙ্গে বেনাপুলের দূরত্ব কমেছে ৯৩ কিলোমিটার। যার প্রভাব বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে পড়বে। বেনাপুল বন্দরের মাধ্যমে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায় বাংলাদেশ। রাজস্ব বৃদ্ধিতেও পদ্মা সেতু ভূমিকা রাখবে এমন আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ অন্তর্ভুক্ত পোশাক কারখানাগুলো এখন একটি বন্দরের ওপর নির্ভরশীল নয়। পায়রা ও মোংলা বন্দরকে তারা বেছে নিচ্ছেন সুবিধাজনক হওয়ায়। এই মুহূর্তে দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ শতাংশ হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আশা করা যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই মোংলা এবং পায়রা বন্দর দিয়ে দেশের ৪০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হবে। সংগত কারণেই চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি আমদানি-রপ্তানিতেও আরো গতি আসবে।
দেশে এখন আটটি ইপিজেড আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে বড় অবদান রাখছে। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে একমাত্র মোংলা এলাকায় একটি ইপিজেড ছিল। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ সুবিধা অর্জনের সুবাদে পটুয়াখালী ও যশোরে দুটি ইপিজেড প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ।
সমালোচকরা এই পদ্মা সেতুকে মেগা-লস হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান এই সেতুকে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি আখ্যায়িত করেছিলেন। এই দেশেরই কিছু অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, এই সেতু অকার্যকর খাত প্রমাণ হবে, যার সূত্র ধরে বিশ্ব ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেবে। বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত। পরিকল্পনাকালে বলা হয়েছিল পদ্মা সেতুর টাকা ওঠে আসতে সাড়ে ৯ বছর সময় লাগবে। কিন্তু সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে যে গতি তৈরি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ শতাংশের বেশি। টাকার অঙ্কে প্রাপ্তির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সেই অর্থে পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় পরোক্ষভাবে প্রথম বছরেই চলে এসেছে!
যদিও পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ আয় হিসেবে টোল আদায়ই দৃশ্যমান। কিন্তু অর্থনীতিতে এর পরোক্ষ অবদান দেশের জিডিপিতে সরাসরি অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় বহন করেছে বাংলাদেশ নিজ তহবিল থেকে। প্রকল্প চলাকালেও বলা হয়েছিল দেশ ফতুর হয়ে যাবে এই সেতুর ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে। কিন্তু এক বছরের পরিসংখ্যান বলে সেতু বিভাগ চার কিস্তিতে অর্থ বিভাগকে ৬২২ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৪২ টাকা পরিশোধ করেছে। তার মানে ফতুর হওয়ার যে আশঙ্কা কিছু ব্যক্তি করেছিল তাদের মন্তব্য মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পদ্মা সেতু দিয়ে রেল যোগাযোগ শুরু হওয়ার অপেক্ষায় এখন। রেল চালু হলে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে এর প্রভাব পড়বে আরো।