পাবনার কৃষক আন্দোলন ও দুই সহোদর মৌলভী আজহার আলী মিঞা ও মৌলভী আফসার আলী মিঞা
একদিকে জমিদারদের শোষন অন্যদিকে নীলকরদের অচ্যাচার বাংলার কৃষককুল দিশেহারা, সময়টা উনিশ শতকের শেষ ভাগ। ঠিক এমনি এক মূহুর্থে ‘‘করেঙ্গে অউর মরেঙ্গে’’ প্রত্যয় নিয়ে অত্যাচারিত কৃষকদের পাশে দেবদূত হয়ে দাড়ান দুই সহোদর। ক্ষণজন্মা এই দুই সহোদর পাবনার ইছামতি তীরের গ্রাম সাথবিলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্ম নেয়া মৌলভী আজহার আলী মিঞা ও মৌলভী আফসার আলী মিঞা। তাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠে কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলনের পথ ধরে পরবর্তিতে বিলুপ্ত হয় জমিদার প্রথা, অবসান ঘটে নীলকরদের অত্যাচার নিপিড়ন। আজ ক্ষণজন্মা এই বিপ্লবীর কথাই তুলে ধরছি।
১৮৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি, ইছামতির তীরে অবস্থিত শাথবিলা গ্রামে জন্ম নেন মৌলভী আজহার আলী মিঞা। এর ঠিক দুই বছর পর, ১৮৭৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, জন্মগ্রহণ করেন তাঁর ছোট ভাই, মৌলভী আফসার আলী মিঞা। তাঁদের পিতা, গোলাম মহিউদ্দিন মিঞা, ছিলেন একজন আলেম ও সমাজচিন্তক, এবং তাঁদের পিতামহ গোলাম পঞ্জাতন ছিলেন এলাকার প্রভাবশালী সমাজনেতা।
শৈশবেই তাঁরা উপলব্ধি করেন, জমিদারদের নিপীড়নে কৃষকেরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। পিতার উপদেশে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা আইন পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা কলেজ থেকে মৌলভী আজহার আলী ১৮৯২ সালে অনার্সসহ আইন পাশ করেন, এবং মৌলভী আফসার আলী ১৮৯৪ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
তাঁরা কলকাতায় থেকে যেতে পারতেন, কিন্তু ফিরে এলেন পাবনার মাঠে। ১৮৯৪ সালের ১৭ আগস্ট তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন “পাবনা কৃষক সমবায় সমিতি”—এ অঞ্চলের প্রথম সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের ভিত্তি।
১৮৮৫ সালের বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট (Bengal Tenancy Act, 1885) কৃষকদের কিছু অধিকার দিলেও জমিদাররা তা মানতে নারাজ ছিলেন। ১৮৯৫ সালে আজহার আলী ও আফসার আলী পাবনা সিভিল কোর্টে একটি ঐতিহাসিক মামলা দায়ের করেন—“রায়চৌধুরী বনাম জমিদার মুকুন্দ লাল সরকার”। এই মামলায় তাঁরা যুক্তি দেন যে, টেন্যান্সি অ্যাক্টে কৃষকের যে অধিকার স্বীকৃত, তা বাস্তবে কার্যকর করতে হবে। আদালত কৃষকদের পক্ষে রায় দেন, যা Bengal Law Reports-এর XV খণ্ডে (1896) প্রকাশিত হয়।
মৌলভী আজহার আলী রাজনীতিতে যোগ দেন কৃষকপ্রজা পার্টির মাধ্যমে। ১৯৩৭ সালের বাংলার সাধারণ নির্বাচনে পাবনা থেকে মুসলিম সংরক্ষিত আসনে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হন। এক ভাষণে তিনি বলেন, “আমাদের কৃষক জমি চাষ করে, খাজনা দেয়, কিন্তু জমির মালিক নয়—এ যে জাতীয় আত্মমর্যাদার লাঞ্ছনা।” এই ভাষণ Star of India পত্রিকায় ১৩ জুলাই ১৯৩৭ তারিখে প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে, মৌলভী আফসার আলী নেতৃত্ব দেন পাবনা মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও কৃষক সম্মেলনে। ১৯৩৮ সালের পাবনা কৃষক মহাসম্মেলনে তিনি বলেন, “যতদিন শিক্ষিত কৃষক সৃষ্টি না হবে, ততদিন শোষণ চলবে।” তিনি সমিতির তৃণমূল সংগঠকদের কাছে “মাওলানা ভাই” নামে পরিচিত ছিলেন।
তাঁদের উত্তরসূরিরাও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। আজহার আলীর চার ছেলে ও চার মেয়ে এবং আফসার আলীর তিন কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রফেসর ডা. মাজহার আলী কাদেরী। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন এবং ২০০০ সালে পাবনা-৫ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁদের গল্প শুধু আইন কিংবা রাজনীতি নয়—একটি জাতির আত্মসম্মান, কৃষকের অধিকার, এবং ন্যায়ের লড়াইয়ের প্রতীক। শাথবিলার সেই শান্ত বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে, যেন বলে, “ন্যায়ের পথ যারা দেখিয়েছেন, তাঁরা অমর।”
তথ্য সূত্রঃ ঐতিহাসিক প্রমাণ ও রেফারেন্স: 1. Bengal Law Reports, Vol. XV, 1896 2. The Calcutta Gazette, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ 3. Star of India, ১৩ জুলাই ১৯৩৭ 4. Pabna Muslim Literary Society Archives, 1938 5. মৌখিক ইতিহাস সাক্ষাৎকার: মোঃ আলী হাসান, ২০০৩ 6. Eaton, R. – The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1993 7. Hardgrave, R. – Peasant Resistance in Colonial India, 1969 8. “স্মৃতির অক্ষরে সোনালি দিনগুলো,” অধ্যাপক জহির আলী কাদেরী, রূপম প্রকাশনী।