টানা ১২টা বছর মেয়েদের ফুটবল নিয়ে কথা ওঠেনি। ভারতকে ছাপিয়ে কীভাব মেয়েরা উপমহাদেশের ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করল তা নিয়ে ভেতরের কথা জানতে চায়নি কেউ। এই পর্যায়ে আসতে মেয়েদের ফুটবল দলের পেছনে বাফুফে কর্তাদের কতটা শ্রম দিতে হয়েছে তা অনেকেরই অজানা। তিল তিল করে গড়ে আজকের অবস্থানে এসেছে মেয়েদের ফুটবল। কথা ছিল মিয়ানমারে অলিম্পিক ফুটবল বাছাইয়ে খেলবে। কিন্তু অর্থসংকট দেখিয়ে নাম প্রত্যাহার করে নেয় এবং এ নিয়ে সমালোচিত হয় বাফুফে।
মেয়েদের ফুটবলে কাজ করতে গিয়ে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন আগেও সমালোচিত হয়েছেন। কেন তাদের পেছনে এত শ্রম দেওয়া হচ্ছে। সেদিকে কান দেননি তিনি। ফুটবল ভবনে মেয়েদের আবাসিক ক্যাম্প চলছে ১২ বছর। টানা প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে দেশি-বিদেশি কোচ, কোচিং স্টাফ এনে ফুটবলারদের গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রামের মেয়েরা আধুনিক খাবার খেতে অভ্যস্ত ছিল না। দৈনন্দিন খাদ্যাভাসে আধুনিক ফুটবল খেলা সম্ভব নয়। মাঠে পারফরম্যান্স করতে হলে খাদ্যাভাসও পরিবর্তন করতে হবে, অস্ট্রেলিয়ান টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল থমাস স্মলি তালিকা দিয়েছিলেন। মেয়েদের ফুটবলে উন্নতি দেখতে হলে সানজিদা, তহুরাদের খাবার অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সবুজ সংকেত দিলেন বাফুফে সভাপতি। কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের সঙ্গে টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলি ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেয়েদের নিয়ে কাজ করলেন। দেশে মেয়েদের ফুটবলে নতুন ছবি আঁকলেন।
কীভাবে উন্নতি করা যায় সেই ভাবনায় বাফুফে সভাপতি তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে জাপান কাতার, চীনসহ নানা দেশে খেলতে পাঠালেন। প্রশিক্ষণ নিতে পাঠালেন। দামি হোটেলে রাখলেন। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। যে মেয়েরা গ্রামের ঘর থেকে বের হতে চাই না সেই মেয়ের পায়ে ফুটবল নিয়ে বিমানে উঠলেন। বিদেশে গিয়ে দেশের পতাকা উজ্জ্বল করলেন। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল নিয়ে এশিয়ার মেয়েরাও এখন প্রশংসা করেন। এশিয়ার ফুটবল দেশগুলো বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল নিয়ে গর্ব করে। আজকের এই মেয়েদের গড়ে তুলতে এই কত শ্রম, কত অর্থ ব্যয় হয়েছে সেই কথা কখনো প্রকাশ করেননি বাফুফে সভাপতি। নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন। পরিচিতদের কাছ থেকে এনে কাজ চালিয়েছেন। অভাব-অনটনের কথা কখনো প্রকাশ করেননি। দেশের মানুষও জানতে পারেননি মেয়েদের ফুটবলে কীভাবে অর্থের জোগান আসে। টানাটানির সংসারে অভাব লেগে থাকলে একটা সময় প্রকাশ পাবেই। সাফল্য পেয়েছে সবাই বাহবা দিয়েছে। কিন্তু যখন অর্থের প্রয়োজন হয় তখন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর চারদিক থেকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তাব আসল। কার আগে কে ছবি তুলবেন ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছিল। উন্মদনা শেষ। মেয়েদের খোঁজ রাখার মানুষও হারিয়ে গেল। ঘুরে ফিরে সেই সালাহউদ্দিনই মেয়েদের পাশে থাকলেও তিনি চাইলেন অর্থ সংকট দূর করতে। মিয়ানমার পাঠানোর জন্য টাকা চাইলেন পেলেন না। হয়ত পেতেন দেরিতে। কিন্তু আশ্বাস না পেয়ে দল পাঠানো গেল না। আগুন জ্বলে উঠল। সালাহউদ্দিনের সমালোচনা। দেশের মানুষ অভাবের কথা জানতে চায় না। তারা জানতে চায় দল যেতে পারেনি কেন। সমালোচনার তীরবিদ্ধ সালাহউদ্দিন সেদিন সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন, ‘একটা কুয়া থেকে কতবার পানি তোলা যায়।’ বুঝাতে চেয়েছেন মানুষের কাছ থেকে কতবার টাকা আনা যায়। সেটা বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ টাকা দিতে চায় না।’ সালাহউদ্দিন হতাশা, সরকারের কাছে পাঠনো সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার বাজেট পাশ না হওয়ায়।
অর্থসংকট আগেও ছিল, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছিল মেয়েদের ফুটবল। তখন কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। নিজেরা টাকা দিয়ে চালিয়েছেন বলেই নষ্ট হয়নি। আজ মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে মেয়েদের ফুটবল। ১২টা বছর কেউ জানতেও চায়নি, খোঁজও নেয়নি কীভাবে চলে। আজ যখন সংকটের কথা প্রকাশ করা হলো তখনই বাধল সমস্যা। সমাধানের পথ না খুঁজে না দিয়ে ভুল-ভ্রান্তি খুঁজে ভিন্ন পথে ঠেলে দিলে আরো বেশি সংকটে পড়বে ফুটবল।