সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সম্পাদক এবং মাসিক আল ইসলাহ‘র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ভাষা সৈনিক মুহম্মদ নুরুল হক সাহেবের কথা আজ বার বার মনে পড়ছে।
তিনি ছিলেন একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক-ভাষা সৈনিক এবং পাঠাগার আন্দোলনের পথিকৃত। আজ বাংলার গ্রামে গঞ্জে গড়ে উঠছে অসংখ্য পাঠাগার। বাংলাদেশের একটি পাঠাগার থেকে লেখা চেয়ে জনৈক ভদ্রলোক ইমেল পাঠিয়েছেন, ইমেলে পাঠাগার বানানটিই ভূল। তখনই বার বার মনে পড়ছে পিতৃতুল্য মরহুম মুহম্মদ নূররুল হক সাহেবের কথা।
কে এই নূরুল হক, আর কেনইবা তার সম্পর্কে লিখতে বসলাম। ছোট বেলা থেকেই বাবা চাচার মুখে নূরুল হক সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। ১৯৭৯ সালে প্রথম তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয় আমার। এর পর থেকে আমার নিয়মিত আড্ডা ছিল সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। সেসময়ে আমরা যারা টুকটাক লেখালেখি করতাম সকলকেই তিনি উৎসাহ দিতেন স্নেহ করতেন। বিশেষ করে আমি যখন নবীগঞ্জের ইতিকথা লিখতে শুরু করি। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য মুসলিম সাহিত্য সংসদে যেত হত। এই বইটি লিখতে তিনি আমাকে যে উৎসাহ অনুপ্রেরণা এবং তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন তা কোন দিন ভূলবনা। এই বইয়ের ভূমিকাও লিখেছেন এবং প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবেও উপস্থিত ছিলেন। ইদানিং সিলেট সম্পর্কে বেশ বইপুস্তক বেরুচ্ছে। সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোল সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই নূরুল হক সাহেবের আশ্রয় নিতে হবে।
আসামের বরাক উপতক্যার ভাষা আন্দোলন ১৯৬১
সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হস্তে লেখা পবিত্র কোরআন শরীফ, সিলেটের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, ফারসী, নাগরী ও ইংরেজী ভাষার অসংখ্য বইপুস্তক, সেসময়কার পত্রপত্রিকা যেমন আমাদের জন্য সংরক্ষন করে রেখে গেছেন। ঠিক তেমনি ভাবে তার সম্পাদিত মাসিক আল ইসলাহ পত্রিকায় পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা অন্দোলনের টুকিটাকি সন তারিখ সহ লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন।
সেসময়কার মাসিক আল ইসলাহ‘র পূরাতন কপি গুলোতে যেমন রয়েছে এসব ইতিবৃত্ত, ঠিক সে সময়কার আমাদের পূর্বসূরী যারা লেখালেখি করতেন তাদের সম্পর্কেও জানার এক ভান্ডার। বিশেষ করে ১৯৩৬ থেকে ১৯৫২ এবং ১৯৫২ পরবর্তি অনেক ইতিহাসের উপাদান। তার একটি কথা আজ বারবার চেখের সামনে ভেসে উঠছে। এক ভদ্রলোক তাকে একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে এসছেন আমিও তার সামনে বসা, ভদ্রলোক খামের উপরে লিখলেন মোহাম্মদ নূরুল হক, সাথে সাথে তিনি বিনয়ের সাথে তার ভূল সংশোধন করে লিখিয়ে দিলেন এভাবে লিখা সঠিক নয়। সঠিক ভাবে কারো নামের আগে মোহাম্মদ লিখতে হলে এভাবে লিখতে হয়। ‘‘ মুহম্মদ ‘‘ আর এটাই সঠিক এবং অর্থবহ। এর পর থেকে মুহম্মদ শব্দটি দেখলে বা শুনলেই নূরুল হক সাহেবের চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই আজ থেকে ৩৭ বছর পূর্বে পরপারে চলে গেছেন। রেখে গেছেন আমাদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশাল এক তথ্য ভান্ডার। জাতি হিসেবে আমরা কি তাঁকে মূল্যায়ন করেছি বা করতে পারছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু অখ্যাতরাও স্বাধীনতা পদক একুশে পদক লাভ করেছেন। অকৃতজ্ঞ এই জাতি নূরুল হক সাহেবের মতো গুলীজনদের মূল্যায়ন করেনি। ভবিষ্যতে কেউ তার নাম উচ্চারন করবে কি না জানিনা?
তার জন্ম ১৯০৭ সালের ১৯ মার্চ সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার ঐতিহ্যবাহি দশঘর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। মুহম্মদ নুরুল হক সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে প্রথমে ‘অভিযান’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করেন। ১৯৩১ সালে এই পত্রিকাই ‘মাসিক আল ইসলাহ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে মুদ্রিত আকারে বের হয়। ১৯৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সরেকওম এ. জেড. আব্দুল্লাহর সিলেট শহরের দরগা গেটস্থ বাসভবনে তৎকালীন সময়ের সিলেটের সাহিত্য প্রেমীদের এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ‘সিলহেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ’ এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এতে মরমী সাধক হাছন রাজার উত্তরসূরী খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রেজা চৌধুরীকে সভাপতি, হযরত শাহ জালাল (র) মাজারের খাদিম সরেকওম এ. জেড. আব্দুল্লাহকে সম্পাদক এবং আল ইসলাহ সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হকসহ দশজনকে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করে সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদের ১৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে নূরুল হক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। আমৃত্যু তিনি এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন নিষ্টা ও সততার সাথে, সম্বৃদ্ধ করেছেন পাঠাগারের ভান্ডার। সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ নামটি উচ্চারণ করলেই মুহম্মদ নূরুল হক নামটি চলে আসে, এযেন একই সূত্রে গাঁথা।
ভাষা আন্দোলনে মুহম্মদ নুরুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের শুরুতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তিনিই প্রথম রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে আওয়াজ তোলেন মুসলিম সাহিত্য সংসদ, মাসিক আল ইসলাহ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নূরুল হক সাহেব সভা সমাবেশসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এক কথায় ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন করে ছিলন মুহম্মদ নূরুল হক।
নূরুল হক ১৯৬১ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক নজরুল সাহিত্য সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। একই বছর তিনি রবীন্দ্র শত বার্ষিকী অনুষ্ঠানের সাহিত্য বিভাগেরও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৪৬-৪৭ সালে আসাম সেন্ট্রাল বুক কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া, ১৯৬৫ সালে গঠিত সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি।
মুহম্মদ নূরুল হককে সাহিত্য ও সমাজসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পদক ও সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৭৭ সালের ১৪ এপ্রিল নূরুল হক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৮৬ সালের ৪ জানুয়ারী বাংলা একাডেমী তাঁকে ফেলোশীপ প্রদান করে। তিনি ১৯৮৭ সালে মরহুম আমীনূর রশীদ চৌধুরী স্মৃতি স্বর্ণপদকও লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে সিলেটের আলোচিত নাট্য সংগঠন নাট্যালোক তাঁকে সম্মাননা ও পদক প্রদান করে। এ ছাড়া, সাহিত্য ও সমাজ সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ নূরুল হক ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকার থেকে ‘তমঘা-ই-খেদমত’ উপাধি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের দেয়া রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘তমঘা-ই-খেদমত‘ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি সিলেট বেতারের জন্মলগ্ন থেকে নিয়মিত কথক ছিলেন। একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। তাঁর ৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য সাধনার নিরলস কর্মী, প্রচার বিমুখ এই বিরল ব্যক্তিত্ব ১৯৮৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরের দরগা মহল্লা, ঝরণারপারস্থ (পায়রা-৫৪) তাঁর নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। তার সন্তানেরা সকলেই সাহিত্য প্রেমী। রোকেয়া খাতুন রুবী একজন কবি ও সাংবাদিক, দ্বিতীয় শুভিও একজন ছাড়াকার, পুত্রদের মধ্যে মরহুম আজিজুল হক মানিক, জোবায়ের এবং তালহা সকলেই সাহিত্য সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত।








