প্রেম ভালবাসা নিয়ে যুগে যুগে অসংখ্য গল্প উপন্যাস নাটক যাত্রাপালা সিনেমা তৈরী হয়েছে। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই মানুষের মাঝে প্রেম ভালবাসা চলে আসছে চলবে অনন্ত কাল। হয়তোবা ভবিষ্যতে আরো অসংখ্য প্রেমের গল্প তৈরী হবে। এই প্রেম ভালবাসা জাতকুল এবং ধর্মের উর্ধে। যখন প্রেমিক প্রেমিকারা একে অন্যকে ভালবাসে তখন কেউ এসবের চিন্তা করেনা, শুধু থাকে একে অন্যকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা। তাইতো কবি বলেছেন ’’সর্গ হতে আসে প্রেম সর্গে যায় চলে’’। রাধা-কৃষ্ণ, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা, দেবদাস-পারবতি‘র ভালবাসার গল্প কমবেশী সকলেই জানেন। এসববের কোনটা কাল্পনিক, কোনটা ধর্মীয় উপখ্যান হলেও বাকিগুলো যুগযুগ ধরে লোকগাঁথা হিসেবে ঠিকে আছে।
ভারত উপমাদেশে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ‘’রজকিনী চন্ডি দাসের’’ প্রেম কাহিনী। এটি ছিল সত্য এবং মর্মান্তিক একটি ভালবাসার পরিণতি। রজকিনী চন্ডিদাসের প্রেম কাহিনী আমাদের বাংলাদেশরই একটি সত্য প্রেমের কাহিনী।
আজ থেকে প্রায় আটশত বছর পুর্বে মাগুরা জেলার এক প্রত্যন্ত এলাকা ধোপাখালি গ্রামে জন্ম হয়েছিল রজকিনী চন্ডিদাসের। ব্রাম্মণপুত্র চন্ডিদাস আর রজকিনি ধোপার মেয়ে। বার বছরে তাদের প্রেমের সফলতা আসলেও পরিবেশ পারিপার্ষিকতার কারণে উভয়কেই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তখনকার কুলিন ব্রাম্মন সমাজ তাদের ভালবাসার স্বীকৃতি দেয়নি। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে সেই রজকীনি চন্ডিদাসের গ্রাম দেখতে গিয়েছিলাম মাগুরার ধুপাখালিতে। সেখানে আজও খুঁজে পাওয়া যায় তাদের স্মৃতি বিজরিত ঘাট, বাড়ির ধ্বংশাবশেষের চিহ্ন ও গোপালমন্দির। ভালবাসার কারণে তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছির পশ্চিম বঙ্গে সেখানে গিয়েও তারা শান্তিতে থাকতে পারেনি। সর্বশেষ এই প্রেমিক প্রেমিকা চলে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনে সেখানে কি ঘটেছিল তা কেউ জানেনা। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে রজকিনি চন্ডিদাসের। তবে পৃথিবী যতদিন আছে রজকিনী চন্ডিদাস বেঁচে থাকবেন যুগ যুগান্তরে।
আমি আজ যে প্রেমিক যুগলের কাহিনি বর্ণনা করছি রজকিনি চন্ডিদাসের উত্তরসূরীদের কোন হদিস না মিললেও এই প্রেমিক যুগলের উত্তরসূরীরা আজও আছেন এই গ্রামে। তাদের মাঝে আছে হিংসা বিদ্ধেস, আছে ভালবাসা আছে আত্মীয়তার বন্ধন। এই ধারা চলে আসছে গ্রামের দুই মুসলিম চৌধুরী পরিবারের মাঝে যুগযুগ ধরে। ইতিহাস সত্য এই কাহিনীর নায়ক নায়িকা হলেন কুলিন ব্রাম্মণ পুত্র মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরী (মখাই) আর সম্ভ্রান্ত মুসলিম কন্যা শেখ শাহ ময়মনা বিবি। এই ঘটনাটি ঘটেছিল ‘‘রজকিনি চন্ডিদাসের’’ চারশ বছর পরে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আগনা পরগনার মধ্যসমৎ বা মধ্যসমস্থ গ্রামে আজ থেকে প্রায় চারশত বছর পূর্বে। উভয়েই কুলিন পরিবারে জন্ম নিলেও তাদের ভালবাসায় বাঁধা হয়ে দাড়ায় ধর্ম। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় ইতিহাস নির্ভর বিভিন্ন লেখকের লেখা একাধিক গ্রন্থ ও লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী এবং উভয় পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় তাহলো মধ্যসমৎ গ্রামের শ্রীমান ধীরেন্দ্র ঠাকুর চৌধুরীর উত্তরসূরী শ্রীবল্লভ চৌধুরীর পুত্র মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরী (মখাই) পেশায় ছিলেন একজন কবিরাজ। কবিরাজির সুবাদে তাঁর যাতায়াত ছিল একই গ্রামের মুসলিম অধ্যসিত মহল্লা (লামলিরপার) এর শেখ শাহ মাখদুম (মাছাই) এর বংশধর শেখ শাহ নাছিরের বাড়ীতে।
এই শেখ শাহ নাছিরের কন্যা ছিলেন খুবই রুপবতি নাম তাঁর শেখ শাহ ময়মুনা বিবি। ক্রমান্বয়ে মুকুন্দ এবং ময়মুনা একে অপরের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। লোক মুখে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে সে সময়কার ব্রাম্মনরা মুকুন্দ ঠাকুরকে সমাজচ্যুত করে। ময়মুনাও মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলেন মুকুন্দকে। কিন্তু তাদের প্রেমে দেওয়াল হয়ে দাড়ায় ধর্ম। ময়মুনা মুকন্দ ঠাকুরকে শর্ত দেন তিনি ধর্ম ত্যাগ করতে পারবেননা। তাঁকে পেতে হলে মুকুন্দ ঠাকুরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তিনি প্রেমিকাকে পেতে জীবন দিতেও রাজি। মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরীর ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হওয়া নিয়ে লোকমুখে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। লোক মুখে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে সে সময়কার ব্রাম্মনরা তাঁকে সমাজচ্যুত করে। ভালবাসার কারনে তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মে ধিক্ষিত হন। নাম ধারণ করেন শাহ নেওয়াজ চৌধুরী।
ভালবাসার টানে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে পৈতৃক ভিটে ছাড়তে বাধ্য হন মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরী (মখাই ছিল তাঁর ডাক নাম)। তৎকালীন কুলীন ব্রাম্মন সমাজ তাঁকে পৈতৃক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে নাপারলেও পূর্বপুরুষের ভিটায় থাকতে দেয়নি। বাধ্য হয়ে মুকন্দ ঠাকুর জন্ম ভিটে ছেড়ে গ্রামের উত্তর-পূর্বকোন ঘেষে বর্তমান কৈলাপুর খেলার মাঠের উত্তর পাশে লামলিরপার মহল্লায় নতুন বাড়ী নির্মান করে বসতি স্থাপন করেন শ্বশুর বাড়ির নিকটে। গ্রামের মানুষের পানীয় জলের সুবিদার্থে গ্রামের উত্তর দিকে একটি দিঘি খনন করেন যা স্থানীয় ভাবে মখাই দিঘি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মখাই ঠাকুরের নতুন এই বাড়িটি তাঁর উত্তরসূরীরা বর্তমানে পাবিবারিক কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করছেন। পরবর্তিতে তাঁর বংশধরেরা নতুন নতুন বাড়ি তৈরী করে অন্যান্য বাড়িতে স্থানান্তিরিত হন।
যে বাড়ী থেকে মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরী (মখাই) ধর্মান্তরিত হয়ে বেরিয়ে এসছিলেন কালক্রমে এই বাড়ীটি আবার ফিরে পেয়েছেন তার উত্তরসূরীরা। বর্তমানে এই বাড়িতে বসবাস করেছন মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরীর বংশধর নজির চৌধুরীর পুত্ররা, আর একেই বলে বিধির বিধান। ‘‘ইতিহাস বড়ই নির্মম কালের পরিক্রমায় কয়েকশত বছর পরে হলেও মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরীর ভাইয়ের উত্তরসূরী প্রভাত চৌধুরীর কাছ থেকে মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরীর বংশধরেরা তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটেটি আবার ফিয়ে পেলেন।‘‘
নিষ্টূর এই পৃথিবী ভাঙ্গা গড়ার নিয়মেই চলছে সেই গানের কলিটি এখানে প্রযোজ্য গানটি হলোঃ-‘‘ নদীর একুল ভাঙ্গে সেকুল গড়ে ঠাকুরও কানাই“‘ আসলেই কে এই কানাই? নশ্বর এই পৃথিবীতে স্রষ্টার লীলা বুঝা বড়ই কঠিণ। এই প্রেমের কারণে শুধুযে মুকুন্দ ঠাকুরকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তা নয়। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে লাঞ্চনা বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে শেখ শাহ ময়মনা বিবির পরিবারকেও।
বিভিন্ন সময়ে ভারত বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কয়েকজন লেখকের লিখা গ্রন্থ (অচ্যুত চরন চৌধুরী তত্ব্যনিধি লিখিত শ্রীহট্রের ইতিবৃত্ত উত্তরাংশ–পূর্বাংশ ১৯১০–১৯১৭ স্বরসতী লাইব্রেরী শিলচার, মতিয়ার চৌধুরী লিখিত বাংলাদেশের প্রথম উপজেলা ভিত্তিক ইতিহাসগ্রন্থ নবীগঞ্জের ইতিকথা দেশকাল প্রকাশনী সিলেট ১৯৮৫, ইতিহাস বেত্তা মনির উদ্দিন চৌধুরী লিখিত ধারাবাহিক নিবন্ধ আগনার ব্রাম্মণদের কথা সিলেট সমাচার/দৈনিক জালালাবাদি ১৯৮০/৮১ ১৯৮৪–১৯৮৫, মাসিক আল ইসলাহ ১৯৩৬ ১৯৪৮) থেকে জানা যায়। মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরীর আদিপুরুষ বিদ্যালংকার গুজরাট থেকে রাঢ়দেশ হয়ে পূর্বাঞ্চলে আগমন করেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্ধেশ্যে। পরবর্তিতে এই বংশের ধীরেন্দ্র ঠাকার চৌধুরী মধ্যসমৎ গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। অন্যদিকে ময়মুনা বিবির পূর্বপুরুষেরা এসছিলেন একই উদ্দেশ্যে সুদুর ইরাকের মাসুল অঞ্চল থেকে। এই বংশের আদিপুরুষ হলেন শাহ শেখ মাখদুম (মাছাই)। শেখ শাহ ময়মুনা বিবি ও মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরী না থাকলেও তাদের ভালবাসার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কালের সাক্ষি হয়ে আজও ঠিকে আছে মুকন্দ ঠাকুর চৌধুরীর নতুন বাড়ি যা বর্তমানে তাঁর বংশধরেরা পারিবারিক গোরস্থান হিসেবে ব্যবহার করছেন, মৃতপ্রায় হয়ে আজও ঠিকে আছে তাঁর খনন কৃত মখাই দিঘির অস্থিত্ব। সেই সাথে আজও তাদের ভালবাসার স্মৃতি হিসেবে ঠিকে আছে শেখ শাহ ময়মুনা বিবির পৈতৃক বাড়িটি যা গ্রামের মানুষের কাছে পশ্চিমের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। তাদের অমর প্রেম কাহিনী লোককথা হিসেবে আজও বাতাশে ঘুড়ে বেড়ায় স্থানীয়দের মুখে মুখে। এই গ্রামের মুকন্দ ঠাকুর চৌধুরীর (মখাই) অধস্থন পুরষদের মধ্যে অন্যতম তাজ মোহাম্মদ চৌধুরী, তাজ মোহাম্মদ চৌধুরীর পুত্র্র কর মোহাম্মদ চৌধুরী, -কর মোহাম্মদ চৌধুরীর পুত্র ফতেহ মোহাম্মদ চৌধুরী, ফতেহ মোহাম্মদ চৌধুরীর পুত্র ফখর উদ্দিন চৌধুরীর বংশধরেরা বিভিন্ন গুত্রে বিভক্ত হয়ে এই গ্রামেই আছেন বর্তমান প্রজন্মের সকলেই মুকুন্দ ঠাকুর চৌধুরীর উত্তরসূরী হিসেবে পরিচিত।
অন্য দিকে এই গ্রামের শেখ শাহ নাছিরের এক পুত্র ও এক কন্যা এরা হলেন হলেন শেখ শাহ ময়মুনা বিবি ও শেখ শাহ জান মোহাম্মদ। জান মোহাম্মদের পুত্র শেখ শাহ হায়দার, শেখ শাহ হায়দারের পুত্র শাহ সাইফ উদ্দিন (ডেফু) এই সাইফ উদ্দিন (ডেফুর) দুই পুত্র শাহ সুনামদি ও শাহ কিয়ামদি, সুনামদির পুত্র শেখ শাহ দানাই, এই শেখ শাহ দানাইর পুত্র দ্বিতীয় মাছাই, মাছাই এর পুত্র শেখ কনাই উল্লাহ। এর পরবর্তি প্রজন্ম আমির শাহ, নূর শাহ, নূর শাহের পুত্র শেখ দাগু ও শেখ কামিল এরা সকলেই অনুরুপ ভাবে বিভিন্ন গুত্রে বিভক্ত হয়ে শেখ শাহ নাছিরের অধস্থন পুরুষ হিসেবে এই গ্রামেই বসবাস করছেন।
মুকন্দ চৌধুরী ও শেখ ময়মুনা বিবি থেকে শুরু করে পরবর্তিতে উভয় পরিবারের সদস্যরা একাধিক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। শাহ শেখ নাছিরের উত্তরসূরী সুরুজ মিয়ার কন্যার দিয়ে হয় মুকন্দ ঠাকুর চৌধুরীর বংশধর গণিমিয়া চৌধুরীর সাথে। আবার দেখা গেছে মুকন্দ ঠাকুর চৌধুরীর উত্তরসূরী কবির চৌধুরীর মেয়ের বিয়ে হয়েছে শাহ নাছিরের বংশধর ইজাজ মিয়া চৌধুরীর সাথে, মুকুনন্দ ঠাকুর চৌধুরীর উত্তর সূরী ইসহাক চৌধুরীর কন্যার বিয়ে হয় শাহ শেখ নাছিরের বংশধর ইউনুস মিয়া চৌধুরীর সাথে। পরবর্তিতে শেখ শাহ নাছিরের উত্তর সূরী আতাউর রহমান বিয়ে করেন জহির চৌধুরীর কন্যাকে।
ময়মুনা বিবি ও মুকুন্দ ঠাকুরের ভালবাসার বন্ধনকে চিরস্থায়ী করে রাখবেন তাদের উত্তসূরীরা। এই বন্ধন আরো জোরালো হবে আত্মীয়তা, ভালবাসা ও সম্প্রিতির মাধ্যমে এই প্রত্যাশা রেখে অমর এই প্রেম কাহিনীর ইতি টানলাম।