পত্রিকান্তরে জানা যায়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট হতে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ানোর বাজেট। বর্তমান অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এমনিতেই বহুগুণে বেড়েছে, বিশেষ করে প্রবীণ বা বয়স্ক এবং নিম্নবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে, তার ওপর আসছে বাজেটে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আরো বাড়নো হয়, তাহলে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকাটাই বড়সংখ্যক একটা জনগোষ্ঠীর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
জানা গেছে, এবারের বাজেটে লেখাপড়ার জন্য ব্যবহৃত কলম, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, টয়লেট ও ফ্যাসিয়াল টিস্যু, বাদাম, মোবাইল ফোনসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য বাড়ানো হবে (মোবাইল ফোন তো প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে আবশ্যকীয় বস্তু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে)। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য বাড়ানোর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো অধিক হারে বেড়ে যাবে। যদিও জানা গেছে, এবারে বাজেটে অধিকসংখ্যক মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ আছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। আসছে অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে দেশব্যাপী বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন ৫৭ লাখ ১ হাজার জন। এর সঙ্গে ১১ লাখ ৪৯ হাজার যুক্ত হলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৮ লাখ ৫০ হাজারে। এর মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবাসহ অনেকেই আছেন। দেশে বর্তমানে প্রবীণ জনগোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫৩ লাখ। এই যে অতিরিক্ত প্রবীণ যে জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের জন্য বাজেটে কী ব্যবস্থা রয়েছে? প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তো বয়স্ক ভাতার তালিকায় পড়েন না বা বয়স্ক ভাতা পান না। বয়স্ক ভাতা বর্তমানে ৫০০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে আসছে বাজেটে ৬০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও এই টাকা দিয়ে বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা ব্যয় মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার পরও এই ১০০ টাকা বাড়ানোর ফলে ১ হাজার ৫২১ কোটি ৯৯ লাখ অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানা যায়। প্রবীণেরা আমাদের সমাজে অপাঙেক্তয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। এসব প্রবীণের অনেকেই না পারেন বয়স্ক ভাতার তালিকায় নাম লেখাতে, না পারেন টিসিবির পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়াতে, না পারেন সন্তানের কাছে হাত পাততে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, তাদের কথা কেউ ভাবছেন না। বাজেটে তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে বহু আবেদন -নিবেদন, লেখালেখি করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩ বাস্তবায়নেরও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা আজ অবধি নেওয়া হচ্ছে না। আরো একটা বিষয় হচ্ছে, এবার আয়কর আইনে করযোগ্য আয় না থাকলেও বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে বলে জানা যায়। এই কর না দিলে সরকারি -বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। প্রশ্ন হলো, আয় না থাকলে আয়কর দেবে কোথা থেকে? যাদের কর দেওয়ার কথা, তারা কেউ কর ফাঁকি দিচ্ছেন, আবার কেউ অসদুপায় অবলম্বন করে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। ১৭ কোটি মানুষের দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ৮০ লাখও না। এর মধ্যে কর দিচ্ছেন মাত্র ২৮ লাখ মানুষ। অথচ বিরাটসংখ্যক করযোগ্য মানুষকে করের আওতায় না এনে বাড়তি কর চাপানো হচ্ছে। করের পরিধি অবশ্যই বাড়াতে হবে, কারণ মানুষ কর না দিলে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হবে কীভাবে? অন্যদিকে মানুষ যেটুকু কর দিচ্ছেন, তার বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। খোদ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তাঘাট ভাঙা, এছাড়া কখনো গ্যাস আছে তো বিদ্যুৎ নেই, আবার বিদ্যুৎ আছে তো পানি নেই। কোনো সমস্যায় পড়লে ধারেকাছে থানায় গিয়ে অভিযোগ করেও কোনো লাভ নেই। জনজীবনের দুর্ভোগ লাঘবের কোনো ব্যবস্থা নেই। জরুরি সেবা পাওয়ার জন্য ৯৯৯ থাকলেও এখানে ফোন করে সেবা পাওয়াটা পরম ভাগ্যের কথা। কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেলে মানুষ পৌর করসহ বিভিন্ন ধরনের কর দিতে উৎসাহী হবেন কেন? পত্রিকান্তরে আরো জানা যায়, ধনীদের সম্পদ কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগামী বাজেটে ধনীদের ওপর করের বোঝা কমানোর প্রস্তাব করবেন অর্থমন্ত্রী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ধনীদের ওপর করের বোঝা কমানো হচ্ছে আর যাদের আয় নেই তাদেরও বাধ্যতামূলক ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে! এ রকম বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় আমরা বসবাস করছি।
দেশে প্রধান যে সমস্যা দুর্নীতি, যার কারণে দেশের উন্নয়নমূলক অনেক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে সময়ক্ষেপণ করে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করা হচ্ছে না। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো হাজার হাজার কোটি টাকা, বিদেশে পাচারকৃত ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা—বিশাল অঙ্কের এই টাকা ফিরিয়ে আনা হলে, আরো বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের টাকা আদায় করা হলে, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক করযোগ্য ব্যক্তিকে করের আওতায় আনতে পারলে অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে না। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজার পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি রোধ করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারলে জীবনযাত্রার ব্যয়ের বোঝা বাড়বে না, আমাদের অর্থনীতি সংকটের মুখে তো পড়বেই না, বরং অর্থনীতির ভিত আরো মজবুত অবস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। দেশে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। মানুষের দুর্ভোগ কমে যাবে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলবে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা স্বচ্ছন্দে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন, তারা আবার কাজে যোগ দিতে পারবেন। বিগত ৫০-৫২ বছরে, অর্থাৎ স্বাধীনতা -পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দেশ আরো এগিয়ে যেত যদি দুর্নীতিকে শক্ত হাতে দমন করা যেত। কিছুসংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের সার্বিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ ক্রমাগত বাড়ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ কিছুটা হলেও রোধ করতে উল্লেখিত বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হলে জনজীবনে সংকট কমে যাবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।