বেসিক ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলা তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশনা আমলে নিচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।বিভিন্ন সময়ে আসামিদের জামিন আদেশের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট দ্রুত মামলার তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেন।আইনের বিধান অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ করার কথা থাকলেও ৭ বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ৫৬ মামলার তদন্ত।
ঋণ বিতরণের নামে ব্যাংকটির প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালে ৫৬টি মামলা দায়ের করে দুদক।এসব মামলায় ব্যাংক কর্মকর্তা,ব্যবসায়ীসহ ১২০ জনকে আসামি করা হয়।কিন্তু অর্থ লোপাট সিন্ডিকেটের হোতা ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে কোনো মামলায় আসামি করা হয়নি।এই রাঘববোয়ালের প্রভাবেই মামলার তদন্ত আটকে আছে বলে দুদকের ভেতরে বাইরে গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে,মামলা তদন্তে বিলম্বের বিষয়ে দুদকের ব্যাখ্যা হাইকোর্ট গ্রহণ না করে বিরূপ মন্তব্য করেছেন।সম্প্রতি হাইকোর্ট বলেছেন,মামলা তদন্তে ‘ফলো দ্য মানি’ নীতি অনুসরণ করার দাবি করে মূলত তদন্তকে অহেতুক প্রলম্বিত করে আসামিদের রক্ষা করার একধরনের চেষ্টা কি না সে প্রশ্ন উদ্ভব হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।মামলায় ফৌজদারি অসদাচরণ এবং আসামিদের দ্বারা অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে কি না এটাই তদন্তের বিষয় হওয়া উচিত।কমিশন ‘ফলো দ্য মানি’- এর নীতি অনুসরণ করে যেভাবে তদন্ত করছে তাতে আদালতের বলতে বাধা নেই যে,কমিশন বর্তমান মামলা তদন্তে ভুল পথ অনুসরণ করেছে এবং করছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন,মামলাগুলোর তদন্ত শেষ পর্যায়ে। অনেক মামলা চার্জশিট দাখিলের জন্য প্রস্তুত আছে।এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।না হলে হাইকোর্ট থেকে কমিশনের ওপর নির্দেশনামূলক কোনো আদেশ প্রদান করা হলে ভবিষ্যতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির অবতারণা হতে পারে।
জানতে চাইলে দুদক সচিব মো.মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন,বেসিক ব্যাংকের মামলা সংক্রান্তে হাইকোর্টের কোনো পর্যবেক্ষণের কথা আমার জানা নেই।তবে কমিশন নিশ্চয়ই দেখছে মামলাগুলোর তদন্ত ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে কি না।এতগুলো মামলার তদন্ত শেষ করতে অনেক সংস্থা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়।বারবার তথ্য চেয়েও অনেক সংস্থার কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায় না।তদন্তের নানা জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই সময় লেগে যায়।
দুদক আইনের ২৮ ধারায় বলা আছে,মামলা দায়েরের পর ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট জমা দিতে হবে।এ সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে আরও ৬০ দিন সময় নিতে পারবেন।কিন্তু মোট ১৮০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিলে ব্যর্থ হলে তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে।কিন্তু সাত বছরেও বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দায়ের করা ৫৬টি মামলার তদন্ত শেষ হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,ঋণ বিতরণের নামে বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৭২৩ কোটি ২ লাখ ৯ হাজার ৮০৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালে ৫৬টি মামলা দায়ের করে দুদক।পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরও সাতটি মামলা দায়ের করা হয়।বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি সংক্রান্ত দুদকের দায়ের করা মোট মামলা ৬৩টি।সমানসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করা হয়।
মামলায় ৮২ জন ঋণগ্রহীতা ছাড়াও বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম,ডিএমডি ফজলুস সোবহান,সাবেক ডিএমডি শেখ মঞ্জুর মোরশেদ,জেনারেল ম্যানেজার এ.মোনায়েম খান,মোহাম্মদ আলী চৌধুরীসহ ব্যাংকের ২৭ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।এছাড়াও বেসরকারি সার্ভেয়ার ১১ জনসহ মোট আসামি ১২০ জন।রহস্যজনক কারণে কোনো মামলাতেই ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি।
জানা গেছে,২০১৫ সালে পল্টন মডেল থানায় দায়ের করা ৩৭ নম্বর মামলার আসামি ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।দীর্ঘ দিনেও মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণ দেখিয়ে জামিন পেতে হাইকোর্টে যান আসামির আইনজীবী।মামলা তদন্তে বিলম্ব ও আসামিকে কেন জামিন দেওয়া হবে তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।রুলের জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতে জবাবি হলফনামা দাখিল করে আসামির জামিনে বিরোধিতা করেন।হলফনামার সঙ্গে মামলা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়,এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অব মানি লন্ডারিং (এপিজি) বাংলাদেশ বিষয়ে ইতঃপূর্বেকার তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ ধরনের তদন্তের ক্ষেত্রে,‘ফলো দ্য মানি’ অর্থাৎ টাকার গতিপথ শনাক্তকরণ বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন।সে অনুযায়ী টাকার গন্তব্য পথ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।সব টাকাই নগদ উত্তোলন করা হয়েছে বিধায় সম্পূর্ণ টাকার গতিপথ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।মামলাগুলো তদন্তাধীন আছে। যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।এই রুলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন,দুর্নীতি দমন কমিশন মামলার তদন্তে ভুল পথ অনুসরণ করেছে এবং করছে।ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিয়মনীতি ভঙ্গ করে অর্থাৎ অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গ এবং অপরাধজনক অসদাচরণ ঘটিয়ে ঋণ দেওয়ার নামে টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছেন কি না সেটাই তদন্তের মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত,ঋণ বিতরণের নামে বেসিক ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো নথির সূত্র ধরে চালানো হয় অনুসন্ধান। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ১২৯টি প্রতিষ্ঠানের হদিস পাওয়া যায়।এর মধ্যে ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আত্মসাৎ করা টাকা বর্তমানে সুদাসলে ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।