তুরস্ক-সিরিয়ায় প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের সমসাময়িক কালে লিজেন্ডারি মার্কিন সাংবাদিক সেইমুর হার্শ প্রকাশ করেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও নরওয়ে মিলে নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনগুলো ধ্বংস করেছে।
তদন্তমূলক সাংবাদিকতার জগতে হার্শের কর্মকাণ্ড ও লিগেসির তুলনা মেলে না। তিনি তার ‘মডুস অপারেন্ডি’ কৌশল প্রয়োগ করে বিশ্ববাসীকে এ পর্যন্ত যেসব স্টোরি উপহার দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে: ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল, সিআইএ পরিচালিত গুপ্ত হত্যা, গ্লোমার ইক্সপ্লোরার, কুখ্যাত মাইলাই হত্যাকাণ্ড বা ম্যাসাকার নামে পরিচিত মার্কিন সেনাদের দক্ষিণ ভিয়েতনামে (মার্চ ১৯৬৮) নিরস্ত্র অসামরিকদের পাইকারি হারে হত্যা, ইরাকের আবু গারাইব জেলখানার বন্দিদের ওপরে মার্কিন সেনাদের অত্যাচার-নিপীড়ন, সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের ‘ফলস ফ্ল্যাগ’, ওসামা বিন লাদেন হত্যা ইত্যাদিসহ সর্বশেষ স্টোরি হলো নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে মার্কিন আক্রমণ।
সংক্ষেপে হার্শের নেরেটিভ এ রকম :২০২২ সালের ৫ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ন্যাটোর ‘অপারেশন বাল্টঅপস-২২’ চলাকালে মার্কিন নেভির ডুবুরিরা চুপিসারে নর্ড স্ট্রিম-১ ও নর্ড স্ট্রিম-২-এর নিচে সি৪ বিস্ফোরক পুঁতে আসে। এই বিস্ফোরক পদার্থকে দূর থেকে সচল করা সম্ভব ছিল, ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নরওয়ে বিমান থেকে ‘সোনার বয়’ (নঁড়ু) ফেলে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
এই অপারেশন সম্পাদনে আমেরিকার ‘স্পেশাল অপারেশনস কমান্ড’-এর পরিবর্তে নেভির ডুবুরি ব্যবহার হয়। কারণ, গুপ্ত বা কভার্ট অপারেশনে ‘স্পেশাল অপারেশনস কমান্ড’ ব্যবহার করতে হলে কংগ্রেসকে রিপোর্ট করতে হয় এবং সিনেট ও হাউজ লিডারশিপকে (তথা ‘গ্যাং অব এইট’) আগাম ব্রিফিং দিতে হয়। শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা এড়াতে নেভির ডুবুরি ব্যবহার করা হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পরিকল্পনা তৈরি শুরু হয়, অর্থাৎ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে ইউক্রেনে রুশ স্পেশাল মিলিটারি অপারেশনের সূচনার দুই মাস আগে থেকে প্ল্যানিং অপারেশনের প্রস্তুতি চলে।
অপারেশনটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেকব স্যালিভান, বৈদেশিক মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। এই তিন জনই আলট্রা নিয়োলিবারেল/নিয়োকন (জারভেটিভ) ভুক্ত।
নর্ড স্ট্রিম-১ ও ২ গ্যাস পাইপলাইন সিস্টেম বাল্টিক সাগরের তলায় ৭৫০ মাইল নিচে পাশাপাশি বসানো হয়েছিল এবং রাশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন দুটি পোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। পাইপলাইনগুলো উত্তর জার্মানিতে পৌঁছানোর আগে প্রথমে এস্তোনিয়া সীমান্তের খানিকটা কাছে দিয়ে নেমে আসে, তারপর সর্বশেষ ডেনমার্কের ‘বর্নহোলম’ দ্বীপের বেশ খানিকটা কাছ দিয়ে সোজা চলে আসে গন্তব্যস্থল জার্মানিতে। জার্মানিসহ তাবৎ ইউরোপের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ‘রক্তনালি’ এই পাইপলাইন সিস্টেম।
বাস্তবে বাইডেন ও তার বৈদেশিক নীতিবিষয়ক টিম কোনো রাখঢাক না করেই এই পাইপলাইনগুলোর প্রতি প্রচণ্ড বিরাগ প্রকাশে কখনোই কার্পণ্য করেননি।
ইউক্রেনে রুশ স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন শুরুর ১৭-১৮ দিন আগে, সেইমুর হার্শের ভাষায়, দ্বিধাগ্রস্ত দোনামনা জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলেসর উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রেস ব্রিফিংয়ে ঘোষণা করেন যে ‘রাশিয়া যদি আক্রমণ করে … নর্ড স্ট্রিম-২ বলে কিছু থাকবে না। সেটি আমরা খতম করে দেব।’
প্রায় একই সময়ে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের এক ব্রিফিংয়ে আন্ডার সেক্রেটারি নুল্যান্ড এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আজকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তো যে কোনোভাবেই হোক না কেন, নর্ড স্ট্রিম-২ কিন্তু সম্মুখবর্তী হবে না।’ অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, প্রেসিডেন্ট ওবামার বৈদেশিক মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ২০১১-১২ সালে জার্মানি ও ইউরোপের কেবল রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে যে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছিলেন, সেটিকে ষোলো আনায় সফল করেন ওবামার সেই সময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
হার্শের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসকর্মের অপরিহার্য সহযোগী ছিল নরওয়ে। নব্বইয়ের দশকে ‘অসলো অ্যাকর্ড’কে যে নরওয়ে সম্ভব করেছিল, সেই দেশ কী করে দুষ্কর্মের সহযোগী হয়, ভাবছেন? একটি কারণ হতে পারে সিআইএর দীর্ঘদিনের অ্যাসেট হিসেবে পরিচিত ন্যাটোর জেনস স্টলটেনবের্গ (যার বিশ্বাস :‘পিস ইজ ওয়ার’), তাছাড়া অসলোর অন্য কোনো মোটিভ যে নেই, হলফ করে বলা কঠিন। যেমন :তার যে যৎসামান্য জ্বালানি রয়েছে দুর্মূল্যের বাজারে বিক্রি করে টু পাইস কামানো! অবশ্য, ২০২২ সালের জুন মাসে নরওয়ের পার্লামেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত একটি সামরিক চুক্তি অনুমোদন করে। এই চুক্তিবলে নরওয়ের চারটি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রকে অবাধ বিচরণের অধিকার দেওয়া হয়।
রুশ-জার্মান-ডাচ-ফরাসি কোম্পানি নিয়ে গঠিত পাইপলাইনের কনসোর্টিয়াম ‘নর্ড স্ট্রিম এজি’র হেড অফিস সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত। এই পাইপলাইনগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ ইইউর অর্থনীতিতে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে, শক্তি-মূল্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং শিল্প-বাণিজ্যে একের পর এক দেউলিয়াত্বের সূচনা করে। ধ্বংস হয় ইউরোপীয়দের ভবিষ্যৎ, ধ্বংস হয় সমৃদ্ধশালী রুশ-ইউরোপীয় সহযোগিতার এবং সৃষ্টি হয় পরিবেশগত বিপর্যয়ের।
২০২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মস্কো ওয়াশিংটনকে ন্যাটো, রাশিয়া ও সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোর জন্য ‘বিভাজনযোগ্যহীন নিরাপত্তা’ বিষয়ে সিরিয়াস আলোচনার অনুরোধ করেছিল (দেখুন : ‘যুদ্ধ হবে কি?’, দৈনিক ইত্তেফাক, ০৪.০২.২০২২)। স্বভাবগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধটির উত্তর না দিয়ে ডিশমিশ করে দেয়। হার্শের প্রতিবেদনে মস্কোর অনুরোধটি উল্লেখিত হয়নি, তবে বলেন যে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে হোয়াইট হাউজ অপারেশনাল পরিকল্পনার কাজ শুরু করে।
এক অর্থে হার্শ অত্যন্ত সহজ-সরল একমাত্রিকভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তার নেরেটিভে জটিল ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে যেমন সন্ত্রাসী আক্রমণের বছরখানেক পূর্বে, বর্নহলম দ্বীপকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ, ডেনিশ ও পোলিশ সরকারের সরাসরি সক্রিয় উপস্থিতি হার্শ ও তার উৎসর কাছে, হয় প্রাধান্য পায়নি অথবা তারা বিষয়টি সম্বন্ধে মোটেই জ্ঞাত ছিলেন না।
(অতি সংক্ষেপে, সন্ত্রাসী আক্রমণের বছরখানেক আগে, ডেনমার্কের বর্নহলম দ্বীপের জলরাশির তলদেশে নর্ড স্ট্রিম-২-এর পাইপ বসানোর ব্যস্তসমস্ত কাজ চলছে; শিগিগর সেখানে মাছ ধরার জাহাজ, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, বিমান নিয়ে পোলিশরা হাজির হন, উদ্দেশ্য :পাইপ বসানো ভণ্ডুল করা, অনেকটা মাস্তানি কায়দায়। এবং জার্মানি ‘কান ফাটানো’ নিঃশব্দ মৌনতা অবলম্বন করে পোল্যান্ডকে উত্সাহিত করে)।
একইভাবে হার্শের প্রতিবেদনে শুরু থেকে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকার কোনো উল্লেখ নেই; এমনকি বিস্ফোরণের ৬০ সেকেন্ড বাদে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ব্লিনকেনকে ‘ইট’স ডান’ মেসেজ পাঠান, সেটি সম্বন্ধেও হার্শ অথবা তার উৎস সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। এবং সন্ত্রাসকর্মের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পৃক্ত থাকার যে ঘোষণা রুশ সরকার দেয়, সেটিও তারা হয়তো জানতেন না।
নর্ড স্ট্রিম আক্রমণের চার দিন বাদে ৩০ সেপ্টেম্বর ক্রেমলিনে লুগানসক, ডনেত্সক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট পুতিন সমগ্র ইউরোপের এনার্জি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য অ্যাংলো স্যাক্সনকে দায়ী করেন।
হার্শ হলেন ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিকতার জগতে কিংবদন্তি সাংবাদিক। তিনি তার প্রতিবেদনের নেরেটিভের এক প্রান্তে বাইডেনকে (সঙ্গে দ্বিধাগ্রস্ত চ্যান্সেলরকে) অভিযুক্ত করেছেন এবং তাদের পেছনে রয়েছে নিয়োলিবারেল/নিয়োকনরা। কিন্তু অদম্য অনুভূতি বলে যে নেরেটিভের আরেক প্রান্তে ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রুশ-ন্যাটো প্রক্সি যুদ্ধের সূচনা ও প্রবহমান রাখার সার্বিক মার্কিন পরিকল্পনার বিষয়টি অনুপস্থিত থেকে গেছে। হার্শ নিশ্চয় অচিরেই তার নেরেটিভে ত্রৈমাত্রিকতা তথা সিরিয়াস ভূরাজনৈতিক পটভূমিতে এই অসামঞ্জস্যতা বা সংগতিহীনতা দূর করবেন।