নশ্বর এই পৃথিবীতে সবাই অবিনশ্বর হয়ে থাকতে চায়। আমাদের স্বীয় কর্মই আমাদের মৃত্যুর পরেও ইহলোকে আমাদের অমর করে রাখে। যেমন :একজন মানবতাবাদী মানুষ বেঁচে থাকেন তার মানবকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। অন্যদিকে একজন রোগাক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী মুমূর্ষু ব্যক্তির জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আকুল আকুতি থাকে, কীভাবে তিনি আরো কিছুদিন এই সুন্দর ধরণীতে বেঁচে থাকবেন। একজন কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত কিংবা ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তিই কেবল বুঝতে পারেন ধরাধামে এক দিন বেশি বাঁচতে পারার স্বাদ কেমন। একজন দৃষ্টিহীনই জানেন সুন্দর পৃথিবীকে দেখার প্রবল বাসনা। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের বদৌলতে এই সমস্ত মানুষের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কাজটি কিন্তু এখন খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। যারা স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্ত অসীমের পানে পাড়ি জমান, তাদের কিডনি, লিভার, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, চোখ এবং এমনকি সম্পূর্ণ শরীর দানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে দিতে পারেন হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অঙ্গদান বা অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন।
অঙ্গদান সাধারণত দুই ধরনের। একটি মরণোত্তর, আরেকটি ক্যাডাভারিক অঙ্গদান। মরণোত্তর বলতে যে কোনো স্থানে মারা যাওয়ার পর অঙ্গদান। এক্ষেত্রে মানুষ মারা যাওয়ার পর শুধু তার কর্নিয়া (যা ছয় ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হয়) প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ক্যাডাভেরিক হলো যাদের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায় এবং যাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় তাদের ক্যাডাভেরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদি তারা ক্যানসার, হেপাটাইটিস, এইচআইভিসহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত না হয়, তবে তারা ক্যাডাভেরিক হিসেবে অঙ্গদান করতে পারে। আইসিইউতে ব্রেন ডেথ রোগীর হার্টসহ অন্যান্য অঙ্গ সচল থাকে। ব্রেন ডেথ রোগীর ব্রেন ছাড়া সব সচল থাকে। এমন রোগী থেকে আটটি অঙ্গ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্য মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে প্রথম জীবিত দাতা থেকে রোগীর দেহে সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে মূলত কিডনি প্রতিস্থাপন বড় আকারে প্রচলিত হয়, তবে এর সবগুলোই ছিল লিভিং ডোনার ট্রান্সপ্ল্যান্ট। মৃত দাতা থেকে কেবল নেওয়া হতো কর্নিয়া, যার প্রচলন হয় ১৯৮৪ সালে। এছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ নেওয়া হতো না। ফলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন দরকার, এমন বহু রোগী থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অঙ্গের সংস্থান করা সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি দেশে অঙ্গদানের বিষয়টি বেশ আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। আর এই আলোচনা শুরু হয়েছে সারাহ ইসলাম নামের এক অদম্য সাহসী লড়াকু মেয়ের হাত ধরে। দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে জীবনপ্রদীপ নিভে যায় সারাহর। মৃত্যুর পরে তার এবং পরিবারের অনুমতিতে সারাহর দুটি কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দুই জন রোগী ফিরে পেয়েছেন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবন। তার কর্নিয়া চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছে আরো দুই জনকে। তবে কিডনি প্রতিস্থাপনটিই বেশি উঠে এসেছে, কারণ বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তি থেকে জীবিত ব্যক্তির দেহে কিডনি প্রতিস্থাপনের শুরু হলো সারাহ ইসলামকে দিয়েই। সারাহর পরপরই আলোচনায় আসে নন্দিতা বড়ুয়া ও জামাল উদ্দিনের দেহদান। গত ৩১ জানুয়ারি আবদুল আজিজ নামে এক ব্যক্তির চোখে বিএসএমএমইউর চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শীষ রহমান নন্দিতার একটি কর্নিয়া সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেন। একই দিনে প্রতিষ্ঠানের অপথালমোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজশ্রী দাস আরেকটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করেন জান্নাতুল ফেরদৌসির চোখে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী গত ৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ৬২ বছর বয়সে প্রাণ হারানো ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা জামালের দুটি কর্নিয়া সংগ্রহ করে।
বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের এক হিসেব মতে, দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি, যা খুবই উদ্বেগজনক। আর ফুসফুসের সমস্যা ও দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দেশে হৃদরোগ, লিভার, ফুসফুস ও চোখের রোগীর সংখ্যা এত ব্যাপক হওয়ার পরেও সমাজে মরণোত্তর অঙ্গদানের সংস্কৃতির প্রচলন তেমন নেই বললেই চলে।
আমাদের দেশে অঙ্গদানকে একটি সামাজিক ট্যাবু হিসেবে ধরা হয় এবং খারাপ চোখে দেখা হয়। জনসাধারণের মধ্যে মরণোত্তর দেহদানের বিষয়ে এক ধরনের অজানা ভীতি কাজ করে। এছাড়া আমাদের বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থাও দেহদান জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনে ব্যাপকভাবে দায়ী। হাসপাতালগুলো এখনো অঙ্গদানের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত হয়ে উঠতে পারেনি। এছাড়া পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছেই। ফলে দাতার দেহ থেকে অঙ্গ নেওয়া, তার সংরক্ষণ এবং গ্রহীতার দেহে প্রতিস্থাপন বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে, রাজধানীর বাইরে অধিকাংশ জেলা শহরগুলোর জন্য এটি একটি রূঢ় বাস্তবতা।
একজনের মরণোত্তর অঙ্গদানের মাধ্যমে প্রায় আট জন নতুন জীবন লাভ করতে পারে। সরকারিভাবে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এছাড়া আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এই বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, এতে শিক্ষার্থীরা জানবে এবং উত্সাহিত হবে। সর্বোপরি দেশের বিদ্যমান চিকিত্সাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো খুবই জরুরি। সব অচলায়তন ভেঙে প্রসারিত হোক অঙ্গদানের মতো জনহিতকর সংস্কৃতি।