বিশ্বে আমরা বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। ভাষা শহিদরা আমাদের আদর্শ হবে—এটাই স্বাভাবিক। শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে ভাষা শহিদদের অবদানের কথা স্মরণীয় করে রাখার জন্য। কিন্তু আমরা যেন সেই সব কথা ভুলে গেছি। শহিদ মিনারের অমর্যাদা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জুতা পায়ে শহিদ মিনারে ওঠা এখন প্রতিদিনকার ঘটনা। যাদের অবদানের জন্য আমরা আজ মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারছি, সেই ভাষা শহিদদের জন্য নির্মিত শহিদ মিনারের অমর্যাদা করা হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পরে এসে শহিদ মিনারের এই অমর্যাদা কালিমা লিপ্ত করছে বাঙালি জাতিকে তথা বাংলা ভাষাকে। অবমাননা করা হচ্ছে সেই মহান শহিদদের। তারা হাসতে হাসতে নিজেদের জীবন দিয়ে গেল, আমরা যাতে মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারি তার জন্য। স্বাধীনতার এত বছর পরও স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি যারা রচনা করেছিলেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত শহিদ মিনারের অমর্যাদা দেশের স্বাধীনতাকেও ক্ষুণ্ন করছে।
বাঙালি বীরের জাতি। শহিদ বেদির অমর্যাদার ফলে সেই বীরত্বকে অবমাননা করা হচ্ছে। শহিদদের প্রতি এই অসম্মান কোনোভাবেই সহ্য করা উচিত হবে না। অল্প কিছু মানুষ এই কাজ করছে, কিন্তু তা পুরো জাতির জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গত বছর পত্রিকায় পড়েছিলাম কুড়িগ্রামের উলিপুর ও নাগেশ্বরীতে বিদ্যালয়ের মাঠে অস্থায়ী গরুর হাট বসানো হয়েছে। যার ফলে বেহাল দশা হয়েছে মাঠগুলোতে থাকা শহিদ মিনার ও বিজয় স্তম্ভের। ফাঁকা জায়গায় বাজার কিংবা যে কোনো কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু শহিদ মিনারে জুতা পায়ে ওঠা কিংবা জিনিস রাখার প্রবণতা পরিহার করা উচিত। এ বিষয়ে বাজার কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকা দরকার।
প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহিদ মিনারে ছোট বাচ্চারা না জেনে বুঝে ওঠে। তাদের বোঝাতে হবে। জানাতে হবে তাদের অগ্রজদের বীরত্ব গাথা। তাহলে তারা কখনোই জুতা পায়ে শহিদ মিনারে উঠবে না। আর যেসব মানুষ জেনে বুঝেও এই কাজ করবে, তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যদি এই কাজ করে তাহলে ধরে নিতে হবে অবশ্যই সে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে করছে। খেলার মাঠের পাশের শহিদ মিনারের ওপর অনেক সময় জামাকাপড় রাখতে দেখা যায়। কিন্তু মাঠে তো অনেক জায়গা রয়েছে, তাহলে শহিদ মিনারের ওপরই কেন রাখতে হবে? এটাও শহিদ মিনার তথা শহিদদের অবমাননার শামিল। আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে এই ব্যাপারে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সর্ব ক্ষেত্রে উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু যে ভিত্তির ওপর এদেশ দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরই যদি অসম্মান করা হয়, তাহলে এই উন্নয়নের কোনো দাম থাকে না।
প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি এলে শহিদ মিনারের কথা মনে পড়ে সবার। কিন্তু সারা বছর শহিদ মিনার যে অবহেলায়, অমর্যাদায় পড়ে থাকে সেদিকে কারো দৃষ্টি নেই। সরকারের উচিত এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। শহিদ মিনারের অমর্যাদাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে ছাত্র সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব ছাত্ররাই দিয়েছিলেন। তাই সব ছাত্রছাত্রীর নৈতিক দায়িত্ব, কেউ যেন তাদের বীর অগ্রজদের বীরত্বের প্রতীককে অসম্মান, অমর্যাদা না করে—সেদিকে খেয়াল রাখা। এই ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।