কৃষি অর্থনীতিতে পোকামাকড় দমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদনে আমাদের কীট ব্যবস্থাপনায় সফল হতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষিতে অন্যতম একটি আলোচিত বিষয় হলো ফল আর্মিওয়ার্ম পোকা। এটি ভুট্টাসহ কয়েকটি ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে এখনই সচেতনতা গড়ে না উঠলে তা সমূহ বিপদের কারণ হতে পারে।
বিশেষত ভুট্টা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাদার ফসল। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রখর সূর্যালোক, উচ্চ তাপমাত্রা, খরা এবং লবণাক্ত সহিষ্ণু এই ফসলের আবাদ আমাদের দেশের অধিকাংশ জেলায় বিস্তৃত হয়েছে। আমিষ, শর্করা ও লিপিড-সমৃদ্ধ এই ফসল উত্কৃষ্টমানের মৎস্য ও পশুখাদ্য। ভুট্টার মোচা পুড়িয়ে বা সিদ্ধ করে চিবিয়ে খাওয়া হয়। এছাড়া সালাদ, স্যুপ, সবজি এবং ময়দা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। দেশে প্রতি বছর এই ফসল চাষের অধীন জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি লক্ষণীয়। বাংলাদেশে রবি মৌসুমে প্রায় ৪ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে এবং খরিপ মৌসুমে প্রায় ৮৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়। দেশে ভুট্টার বার্ষিক মোট উৎপাদনের পরিমাণ ৫৪ লাখ মেট্রিক টন।
সাম্প্রতিক কালে সম্ভাবনাময় এ ফসলটির চাষ ক্রমাগত সম্প্রসারণের সঙ্গে চাষের ঝুঁকির মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত বিগত তিন বছর যাবত উল্লম্ফন গতিতে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার সংক্রমণ ভুট্টাচাষিদের আতঙ্কিত করেছে। বাংলাদেশে ভুট্টা ফসলের মাঠে ফল আর্মিওয়ার্ম এবং কাণ্ডের মাজরা পোকা মারাত্মক ক্ষতিকর আপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফল আর্মিওয়ার্ম পোকা বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৮ সালে। গত বছর এই পোকা দেশের ৪৮টি জেলায় ৩৫ শতাংশ জমিতে সংক্রমণ করেছিল। এ বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে সংক্রমণ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের ভাষ্য অনুযায়ী অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাণ্ডের মাজরা পোকার সংক্রমণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফল আর্মিওয়ার্ম এবং কাণ্ডের মাজরা পোকা উভয়ের জীবনেই চারটি দশা থাকে। দশাগুলো হলো—ডিম, কীড়া বা শূককীট, মুককীট এবং মথ বা পূর্ণাঙ্গ পোকা। উভয় পোকার কীড়া বহুভোজী। ফল আর্মিওয়ার্মের কীড়াগুলো প্রায় ৮০ প্রজাতির গাছপালায় সংক্রমণের মাধ্যমে কৃষি ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে। ভুট্টা ব্যতীত ফল আর্মিওয়ার্মের প্রধান পোশাক উদ্ভিদগুলো হলো—তুলা, জোয়ার, ছোলা, তামাক, বাঁধাকপি ইত্যাদি। ভুট্টার কাণ্ডের মাজরা পোকার অন্যান্য প্রধান পোশাক উদ্ভিদগুলো হলো জোয়ার, বাজরা, ইক্ষু এবং ধান।
ফল আর্মিওয়ার্মের মথগুলো ৩২ থেকে ৪০ মিলিমিটার লম্বা, তাদের সামনের পাখা যুগল বাদামি বা ধূসর রঙের এবং পেছনের জোড়া ধূসর সাদা। পুরুষ পোকার সামনের প্রতিটি পাখায় একটি করে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাদা দাগ থাকে এবং পাখাগুলো স্ত্রী পোকার পাখার চেয়ে অধিকতর নকশা খচিত। পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কীড়াগুলো ৩০ থেকে ৪০ মিলিমিটার লম্বা, তামাটে সবুজ বা কালচে বর্ণের হয়। এদের দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর আলকাতরা সদৃশ ডোরা দাগ এবং দেহের পশ্চাত্ভাগের প্রস্থ বরাবর অবনমিতভাবে ধূসর-হলুদ রঙের ডোরা দাগ থাকে। কীড়াগুলো গাছের পাতা এবং ফল খায় এবং পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে অধিকতর পেটুক হয়ে ওঠে। এ সময় তারা প্রাথমিক অবস্থার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি খাবার খায় এবং এক রাতের মধ্যে খেতের সমস্ত ভুট্টা ফসল বিনাশ করে। ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার কীড়ার প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। স্বভাবতই রবি মৌসুমের নাবী ফসল হিসেবে চাষকৃত ভুট্টায় ফল আর্মিওয়ার্মের সংক্রমণ অধিকমাত্রায় হবার আশঙ্কা থাকে।
ফল আর্মিওয়ার্মের একটি স্ত্রী মথ গাছের পাতার নিচের দিকে ১ হাজার ৫০০টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ডিম ফুটে কীড়া বের হয়। কীড়াগুলো তিন থেকে সাত দিন গুটির মধ্যে আবদ্ধ থেকে ভূগর্ভে মুককীট দশা অতিক্রম করে পূর্ণাঙ্গ পোকা বা মথ হয়ে বেরিয়ে আসে। মথগুলো ১০ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত বাঁচে। ফল আর্মিওয়ার্ম বছরে ছয়টির অধিক বংশধর তৈরি করতে পারে। মথগুলো দ্রুত উড্ডয়নক্ষম এবং তাদের ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে কয়েক শ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে বিস্তৃত হতে দেখা যায়।
কাণ্ডের মাজরা পোকার মথের পাখার বিস্তৃতি ২০ থেকে ২৫ মিলিমিটার, সামনের পাখা বাদামি বর্ণের, ঘন আঁশ যুক্ত এবং লম্বালম্বিভাবে হলুদাভ নকশা খচিত। পুরুষ মথের পেছনের পাখার রং ফ্যাকাশে খড়ের মতো এবং স্ত্রী পোকার পেছনের পাখা সাদা। কীড়াগুলোর দেহ হলদে বাদামি এবং মাথা বাদামি রঙের। কীড়াগুলো ভুট্টা গাছের চারা অবস্থা থেকে মোচা আবির্ভাব হওয়া পর্যন্ত সংক্রমণ করে থাকে। নবীন কীড়াগুলো হামাগুড়ি দিয়ে গাছের অগ্রভাগে চলে যায়। সেখানে তারা মোড়ানো কচি পাতা খায় এবং গাছের অঙ্কুরে ছিদ্র তৈরি করে। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কীড়াগুলো ভুট্টাগাছের কাণ্ডের পর্বসন্ধির সন্নিকটে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে। অতঃপর কীড়াগুলো সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভেতর থেকে খাদ্য আহরণ করে। কাণ্ডের মাজরা পোকা আক্রান্ত গাছের শীর্ষপত্র এবং অঙ্কুর শুকিয়ে গাছ মারা যায়। মাজরা পোকার স্ত্রী মথ পাতার নিচের দিকে ডিম পাড়ে। একটি মথ ২৫টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে কীড়া বের হয় এবং সেগুলো ভুট্টা গাছে সংক্রমণ শুরু করে। কীড়া সাত বার খোলস পরিবর্তন করে ২৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে কাণ্ডের মধ্যে মুককীট দশায় চলে যায়। মুককীট অবস্থায় দুই থেকে ১৫ দিন থাকে। অতঃপর মথ হয়ে বেরিয়ে আসে। মথগুলো দুই থেকে ১২ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
ফল আর্মিওয়ার্ম এবং কাণ্ডের মাজরা পোকার সংক্রমণ হলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। ভুট্টাগাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়ে আক্রমণ হলে এবং আবহাওয়া পোকার অনুকূলে থাকলে সংক্রমণ মারাত্মক হবার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে ফল আর্মিওয়ার্ম এবং কাণ্ডের মাজরা পোকা দমনের জন্য ক্লোরান্টানিলিপ্রোল শ্রেণির কীটনাশক যেমন কোরাজেন ১৮ দশমিক ৫ এসজি বা সাইপারমেথ্রিন শ্রেণির কীটনাশক যেমন সিমবুশ ২৫ ইসি প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক ৫ মিলি মিশিয়ে গাছে সিঞ্চন করা। অথবা এমামেক্টিন বেনজয়েট শ্রেণির কীটনাশক যেমন প্রোক্লেইম ৫ এসজি প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক ৫ গ্রাম, বা থায়ামিথোক্সাম ও ক্লোরান্টানিলিপ্রোল শ্রেণির কীটনাশক ভিরটাকো ৪০ ডব্লিউজি প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক ৪ গ্রাম মিশিয়ে গাছে সিঞ্চন করা। দেশের জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টিচাহিদা নিশ্চিতকরণে ভুট্টা উৎপাদন প্রতি বছর ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই ফসল অনিষ্টকর কীট থেকে সুরক্ষা না করলে কৃষক ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং ভুট্টা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।