আমরা এমন একসময়ে বাস করছি যেখানে সম্পদ হচ্ছে ‘তথ্য’ আর শক্তি হলো ‘প্রযুক্তি’। যে সমাজ, যে রাষ্ট্র প্রযুক্তিতে যত এগিয়ে, তার বাহাদুরি ও প্রভাব তত বেশি। প্রযুক্তির বিপ্লব ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে একবিংশ শতকের ডিজিটাল যুগে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তোলা যে সম্ভব নয়—এই কথায় কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা ভাবের আদানপ্রদান তো করছিই; কথা বলছি, গল্প করছি ও প্রশ্নও করছি। প্রযুক্তিও তার জবাব দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে—প্রযুক্তি কোন ভাষায় আমাদের জবাব দিচ্ছে, প্রযুক্তির ভাষা কী?
সত্যি বলতে, প্রযুক্তির নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। মানুষ তাকে যা-ই শেখাবে, তা-ই রপ্ত বা আয়ত্ত করবে। যে কোনো নতুন আবিষ্কৃত প্রযুক্তিকে বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে সবার সুবিধার্থে তার ভাষা হিসেবে সাধারণত ইংরেজিকে নির্ধারণ করা হয়। তবে যে কোনো দেশে সত্যিকার অর্থে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটাতে চাইলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রযুক্তির বার্তাকে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়া লাগবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই কাজটি করতে হলে প্রযুক্তিকে অবশ্যই সেখানকার মাতৃভাষার উপযোগী করে তুলতে হবে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। আমরা ইতিমধ্যে গুগল অ্যাসিসট্যান্ট সেবার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। গুগল অ্যাসিসট্যান্টকে মুখে কমান্ড দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নানা কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। তবে সেখানে কমান্ড হিসেবে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি হিন্দি, কোরিয়ান, চাইনিজসহ বেশ কিছু ভাষা সাপোর্ট পেলেও বাংলাভাষার অস্তিত্ব এখনো পর্যন্ত নেই। ফলে এই সেবাটি পেতে আমাদের ইংরেজি বা নির্ধারিত অন্য কোনো ভাষার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ইংরেজিতে আমাদের মনের ভাবের সারাংশটি বোঝানো গেলেও ক্ষেত্রবিশেষে পরিপূর্ণতা আসে না, তৃষ্ণা মেটে না। ফলে গুগলের এই সেবাটিকে আমরা ‘আমাদের’ অঞ্চলে ‘আমাদের’ মতো করে ব্যবহার করতে পারছি না। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতেও পারছি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক এই যুগে যে কোনো ভাষাকে যদি ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করা না হয় তবে সে ভাষার সতেজতা নষ্ট হবে। এমনকি বিলুপ্ত হওয়ারও আশঙ্কাও তৈরি হবে। বাঙালি রক্ত ঝরিয়ে নিজের ভাষার মান অক্ষুণ্ন রেখেছে। ভাষার জন্য রক্ত ঝরাতে হয়েছে পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত অনন্য; কিন্তু হতাশার খবর হলো—যে বাংলা বুলিতে কথা বলার জন্য বাঙালি রাজপথে তাজা প্রাণ দিল, সেই বুলি স্মার্ট যুগে এসেও এখনো পরিপূর্ণ স্মার্ট হতে পারেনি। গুগল সার্চ ইঞ্জিনসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ভয়েজ হিসেবে ইনপুট দেওয়া সম্ভব হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা বিশ্লেষণ, ইন্টারনেট অব থিংসসহ নানা ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা আসেনি। এমনকি বাংলা ফন্ট ব্যবহারেও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। বিশেষ করে যুক্তাক্ষর, ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ফন্টের সাইজের তারতম্যের সমস্যাটা প্রকট। যেখানে ফন্টের মতো বেসিক বিষয়েও গলদ রয়ে গেছে, সেখানে স্পেল চেকার, অভিধান, ওসিআর নিয়ে কথা বলাই বাহুল্য। এই ব্যাপারগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশনের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব নয়।
আশার খবর হলো, সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, আগামী ৫০ বছরে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ব্যবহারের দিক থেকে বাংলা হবে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ভাষা। ২০১৭ সালে প্রযুক্তিতে বাংলাভাষার উন্নয়নে ১৬টি টুলস তৈরির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাংলা ডাটা মাইনিং করে আরো বেশি গবেষণা চালানো দরকার। প্রত্যাশা রাখি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অচিরেই বাংলা ভাষা প্রযুক্তিবান্ধব হয়ে উঠবে।