জুলাই সংকটে লন্ডন
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যখন লন্ডনে পৌঁছান তখন বাংলাদেশ কোটা-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসে (FCDO) বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন আরকেটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আয়োজন করে। এই কূটনৈতিক ব্যস্ততার আড়ালে আমাদের মনে ছিল গভীর উদ্বেগ; কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম, দেশের পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

মন্ত্রী এক সরকারি সফরে বেলজিয়ামে ছিলেন। সেখান থেকে ট্রেনে লন্ডনে আসেন। আমি এবং হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম মন্ত্রীকে সেন্ট প্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল স্টেশনে অভ্যর্থনা জানাই। সেই বিশাল ও প্রাণচঞ্চল স্টেশনে চিরচেনা কোলাহল ছিল, ভিড়ের মধ্যে মানুষজন ব্যস্তভাবে চলাচল করছিল। ট্রেন চলাচল ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষার সময়ও আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিলো এক ধরনের অনিশ্চয়তা। তবু আমরা আমাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম এই আশায় যে আমাদের দেশে অস্থিরতা কেটে যাবে এবং সংকট নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমরা যা জানতাম না – জানার কোনো উপায়ও ছিল না – তা হলো ইতিহাস ইতিমধ্যেই তার নীরব দিনগণনা শুরু করে দিয়েছিল। মাত্র চার দিনের মধ্যেই শেখ হাসিনার সম্ভবত শেষ মেয়াদের সমাপ্তি এতে লিপিবদ্ধ হচ্ছিলো।
এদিকে, রাজধানী ঢাকা থেকে দুটি জরুরি নোট আসে। ২৫ জুলাই পররাষ্ট্র সচিব একটি ফ্যাক্স পাঠান। ফ্যাক্সটির শেষ বাক্য ছিলোঃ “আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের এখানকার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসবে।” কিন্তু এই আশার বাণী বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি। যখন অস্থিরতা বাড়ছিল এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হতে শুরু করছিল, তখন শুধু আশার কথা বলে সরকার নিজের দুর্বলতা এবং জনবিচ্ছিন্নতাকেই প্রকাশ করছিল।
ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা
২৮ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাত্রদের তীব্র আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়ে একটি বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয় যে সরকারের অবস্থান ও পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এতে বিচারবিভাগীয় একটি কমিশনের তদন্তের কথাও উল্লেখ করা হয়; ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় এবং শিক্ষার্থীদের ও বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার অঙ্গীকার করা হয়। আরও জানানো হয় যে, মন্ত্রী পর্যায়ের একটি কমিটি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সমাধানের জন্য আলোচনা করছে।
বিবৃতিতে দাবি করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশন ভাষণে সমাধানের আশ্বাস দেওয়ার পরও এবং সরকার দাবি পূরণে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও, স্বাধীনতাবিরোধী ও চরমপন্থী গোষ্ঠী, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত চক্র এই আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে। এদের “হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর”-এর জন্য দায়ী করা হয়। বলা হয়, এই চক্রই সরকারি স্থাপনা, যানবাহন এবং এমনকি একটি কারাগারে হামলা চালিয়েছে। এসময় আইন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকরা আহত বা নিহত হয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। আরও জানানো হয় যে, মূল “কোটা সংস্কার আন্দোলন”-এর সমন্বয়কারীরা সহিংসতার নিন্দা করেছেন।
বিবৃতিতে সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের বিধান মেনে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের মাধ্যমে চলমান অচলাবস্থা সমাধানের ব্যাপারে সরকারের আত্মবিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এতে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর কথা বলা হয় এবং বিষয়টিকে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ তার উন্নয়নের জন্য বিদেশি সহায়তার প্রশংসা করে। স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে দেশব্যাপী কারফিউ এবং সামরিক বাহিনী মোতায়েনের ঘোষণাও দেওয়া হয়। বিদেশি গণমাধ্যমকে যাচাইবিহীন বা ভুল তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হয়।
২০২৪: যখন বাংলাদেশ ধ্বংস হলো -৪র্থ পর্ব
এই বিবৃতিটি FCDO, গণমাধ্যম, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং হাইকমিশনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও প্রচার করা হয়। কিন্তু এত প্রচার সত্ত্বেও কোনো পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। এই নীরবতা ছিল এক কঠিন বাস্তবতার পূর্বাভাস। এই যোগাযোগগুলো ঢাকার আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলেও আড়ালে একটি গভীরতর, আরও অস্বস্তিকর বাস্তবতা উন্মোচিত হচ্ছিল।
“আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার“: বিদ্রূপ যখন ঢাল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই কঠিন সত্যটি প্রকাশ পায়। যা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছিল, তা এক বিশাল দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপ নেয়। এসময় “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার!”—এই ব্যাঙ্গাত্মক স্লোগানটি যাদুমন্ত্রের মতো হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় টেনে আনে।
স্লোগানটি আন্দোলনকারী ছাত্ররা শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৪ জুলাইয়ের এক সংবাদ সম্মেলনের পর। একজন সাংবাদিক কোটা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা যদি কোটা সুবিধা না পায়, তাহলে কি তা রাজাকারদের নাতি-নাতনিদের কাছে যাবে? এটাই আমার প্রশ্ন, দেশবাসীর প্রশ্ন।”
শেখ হাসিনার এই মন্তব্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কয়েক ঘণ্টা পর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ শুরু করে, যা মধ্যরাতেই রাজু ভাস্কর্যের কাছে এক বিশাল সমাবেশে পরিণত হয়। সেখানে তারা “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার!” এবং “চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার” স্লোগান দিতে থাকে।
বাংলাদেশে “রাজাকার” কেবল একটি অপমানকর শব্দ নয়। এটি এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতা এবং রক্তপাতের ভয়াবহ স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, তাদের বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার হয়। রাজাকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মানে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হওয়া। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাজাকার শব্দটিকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের এক শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করে— এই স্লোগান বিদ্রোহের শক্তিতে পরিণত হয়।
এই কৌশল নতুন নয়। সারা বিশ্বে বিক্ষোভকারীরা বিদ্রূপকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী মোদির নিজেকে ‘চৌকিদার‘ (রক্ষক) হিসেবে দাবি করার পর তার সরকারের বিরুদ্ধে যখন রাফাল যুদ্ধবিমান চুক্তি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তখন বিরোধী কংগ্রেস বিদ্রূপ করতে “চৌকিদার চোর হ্যায়“ (পাহারাদার চোর) স্লোগানটি ব্যবহার করে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এটি ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একটি তীব্র রাজনৈতিক আক্রমণ। অবশ্য বিজেপির নেতা ও সমর্থকরা নিজেদের নামের আগে “চৌকিদার“ যোগ করে—”ম্যাঁ ভি চৌকিদার” (আমিও পাহারাদার) পাল্টা স্লোগান দেন। মজার বিষয় হলো, এই স্লোগান পরবর্তীতে ভারতের বাইরেও ব্যবহৃত হয়—পাকিস্তানে ইমরান খানের সমর্থকেরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে একই স্লোগান ব্যবহার করে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর “নট মাই প্রেসিডেন্ট“ স্লোগান যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ছিল একটি প্রতীকী প্রত্যাখ্যান—নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার নয়; ট্রাম্পের রাজনৈতিক অবস্থান, বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্য এবং অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে একটি নৈতিক অবস্থান।
২০২৪ সালের আগে “তুই রাজাকার” স্লোগানটি বাংলাদেশে বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে জনতার ঘৃণা ও প্রতিবাদের এক প্রতীকী, কিন্তু বলিষ্ঠ মত প্রকাশের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিলো। এই স্লোগানটি জনপ্রিয় হয় হুমায়ূন আহমেদ রচিত ১৯৮৮ সালের টেলিভিশন নাটক বহুব্রীহি-তে ব্যবহৃত একটি সংলাপ থেকে। ওই নাটকে একটি টিয়া পাখি বারবার বলছে: “তুই রাজাকার”। এ দৃশ্য এরশাদের সামরিক শাসনের অধীনে ছিল রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞাকে ব্যঙ্গ করার এক নিঃশব্দ অথচ জ্বালাময়ী প্রতিক্রিয়া।
২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এই স্লোগান আবার প্রতিধ্বনিত হয়। তরুণ প্রজন্ম “তুই রাজাকার” স্লোগানে আন্দোলিত করে তোলে গোটা দেশ। “তুই রাজাকার” স্লোগানের ভেতরকার তীব্র আবেগ শুধু যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে ঘৃণা নয়—এটি ছিল তরুণদের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষার এক বিস্ফোরণ। শাহবাগ আন্দোলনে এই স্লোগান যেন সময়ের সীমানা অতিক্রম করে নতুনভাবে অর্থবহ হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের পর যে বিচারশূন্যতা থেকে বহু প্রশ্নের জন্ম, শাহবাগ আন্দোলন ছিল সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার এক সাহসী প্রয়াস। আওয়ামী লীগ সরকার তখন এই তারুণ্যের আন্দোলনকে সম্পূর্ণ গ্রহণ না করলেও তাদের আবেগের ভাষা ও দাবি উপেক্ষা করেনি—এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
কিন্তু ২০২৪ সালে এই ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক কৌশল যে ক্ষমতার বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তার পরিণতি কী হয়েছে তা আজ ইতিহাস। কেন পারনি বা করেনি তার অন্তরালে যেসব কারণ রয়েছে, রাজনীতির ইতিহাস নিশ্চয় একদিন তা উন্মোচন করবে।
আগুনে পেট্রোল
শেখ হাসিনার মন্তব্য হয়তো আবেগপ্রবণ ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা সময়োচিত ছিল না। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের মধ্যেই নয়, দেশজুড়ে এবং বিদেশেও তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের “রাজাকার” স্লোগানের জবাবে বলেন ছাত্রলীগ “এই ধরনের উস্কানির জবাব দেবে।” তিনি আরও বলেন, এই স্লোগান “স্ব-ঘোষিত রাজাকারদের” উন্মোচন করেছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন স্লোগান প্রদানকারীদের আরও কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারি দেন।
দুদিন পরই ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার একটি ভিডিও বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনা ছাত্র বিক্ষোভকে আরও তীব্র করে তোলে, যা “আগুনে পেট্রোল ঢালার“ মতো ছিল। ১৭ জুলাই বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো “চাকরির কোটা নিয়ে বাংলাদেশে মারাত্মক অস্থিরতা” শিরোনামে খবর প্রকাশ করে। এসব খবরে ছয়জন নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র ১৮ জুলাই ইস্ট লন্ডনের মাইক্রো বিজনেস সেন্টারের ভেতরে আওয়ামী লীগ ও বাইরে বিএনপি-র সমর্থকরা অবস্থান নিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেখানে দুই পক্ষ চেয়ার–ছোড়াছুড়ি করে। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ উভয় পক্ষকে নিবৃত্ত করে। এ সময় দুজনকে আটক করলেও পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

এরপর ২২ জুলাই ট্রাফালগার স্কয়ারে একটি বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে সেখানে জড়ো হন। আলতাব আলী পার্ক থেকে শুরু হয়ে পার্লামেন্ট স্কয়ার পর্যন্ত মিছিল করে তারা ‘রাষ্ট্রীয় সহিংসতার’ নিন্দা জানায়। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত এবং বিভিন্ন মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরাও অংশ নেয়।

এরপর যুক্তরাজ্য শাখা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘাত–সহিংসতার ঘটনার প্রতিবাদে ২৯ জুলাই লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ার ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয়। এই সমাবেশে দুই দলের অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত থাকলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সমাবেশকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল।
ভুল ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ
গুরুতর এবং ক্রমবর্ধমান সংকটের মধ্যে ২৮ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে ছাত্র বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪৭ জনে দাঁড়িয়েছে। লন্ডনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম এবং আরো দুজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের সাথে আমি FCDO-তে একটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাজ্যের সরকারকে অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সমর্থন চাওয়া।
FCDO দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে বলে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামুয়াতে আসন্ন কমনওয়েলথ হেডস অফ গভর্মেন্ট মিটিংয়ে (CHOGM) যোগদানের সুপারিশ করে – যাতে তিনি সংকটের বিষয়ে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী CHOGM-এ তার অংশগ্রহণ বাতিল করেন— তিনি দেশে থেকে সরাসরি অস্থিরতা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন।
৩ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডন ত্যাগ করার সময় হাইকমিশনার এবং আমি তাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেই। পথে আমরা বিক্ষোভ কখন, কীভাবে শেষ হতে পারে সেসব নিয়ে আলোচনা করি। তখন অনুমান করা হয়েছিল যে শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেবে। আমার কাছে এমন একটি ধারণা মোটেই বাস্তবতা-ভিত্তিক মনে হয়নি। মাত্র দুদিন পরই প্রমাণ হয় যে ধারনাটি ছিলো একটি চরম ভুল — ক্ষমতা কীভাবে নেতৃত্বকে কখনো কখনো অন্ধ করে দেয়, বাস্তবতা অনুধাবন করা, পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করা থেকে দূরে রাখে এটা তারই পুনরাবৃত্তি।
এই সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ১ আগস্ট বাংলাদেশ সরকার জামায়াত-ই-ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯-এর অধীনে নিষিদ্ধ করে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, গণহত্যা এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অভিযোগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও অস্থিরতা দমনের উদ্দেশ্যে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, এর সুদূরপ্রসারী ও উল্টো ফলই বড় হয়ে দেখা দেয়। শিবিরের নেতা ও কর্মীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সরকার পতনের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার জামায়াত-ই-ইসলামীর মতো ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিল। এই পদক্ষেপ নতুন প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোকে সুদৃঢ় করার জন্য নেওয়া হয়েছিল। কিন্ত্য এই নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (পিবিসিপি)-এর মতো বামপন্থী দলগুলোর শক্তি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ছাত্র, শ্রমিক এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। কারণ ইসলামী চরমপন্থীরা তখন বামপন্থী দলগুলোতে অনুপ্রবেশ করেছিলো। ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদঃ –মতিয়ার চৌধুরী।
আশেকুন নবী চৌধুরী একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কূটনীতিক ও লেখক









চমৎকার, আপনার লেখনি।শেখ শুরুতেই মারমুখী পদক্ষেপ নিয়ে মারাত্মকভাবে নিজের পতন দ্রুত করেছেন। তিনি চীন সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে এসেই যদি সাথে সাথে আন্দোলন কারীদের গণভবনে চা চক্রের আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘোষণা দিতেন কোটা প্রথা বাতিল।তাহলে হয়তো দৃশ্যপট বদলে যেত।কারণ তখন ছাত্র বিক্ষোভ শুধু মাত্র শাহবাগ এলাকাজুড়ে সীমাবদ্ধ ছিল। সর্বোচ্চ হাজার দুয়েক ছাত্র ছাত্রী আন্দোলন করছিল। শেখ হাসিনার প্রয়োজন ছিলনা জাতির উদ্দেশ্য উল্টা পাল্টা ভাষণ দেয়ার।
ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য। আমরা পুরোপুরি আপনার মতের সাথে একমত।