শেখ হাসিনার পতনের কারণ-এক
সব বিপ্লবই গণ-অভ্যুত্থান নয়
দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত শাসনের হঠাৎ পতন সব সময় অস্ত্রের ঝনঝনানি কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের গর্জনের ওপর নির্ভর করে না। বরং ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায় তখনই যখন কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ সময়ের ভাষা বুঝে। তারা সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে, সুকৌশলে জনগণের আবেগকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে অসাধারণ স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়। তাদের অস্ত্র—গভীর ষড়যন্ত্র, অদৃশ্য সংগঠন, কিছু প্রতিশ্রুতির মায়া এবং এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

গত একশ বছরের গণ-আন্দোলনের ইতিহাস অন্তত সেই ধারণাই দেয়। পেত্রোগ্রাদ থেকে বুখারেস্ট, ক্যাপিটাল হিল থেকে কলম্বো, আরব স্প্রিং থেকে ঢাকা—এই ঘটনাগুলোর প্যাটার্ন লক্ষণীয়ভাবে একই রকম। বলশেভিকদের সেল, বুখারেস্টে সেনাসমর্থিত গণঅভ্যুত্থান,ক্যাপিটাল হিল দখলের নেটওয়ার্ক কিংবা কলম্বোর তরুণদের ডিজিটাল সংগঠন—সবই প্রমাণ করে বিপ্লবের আগুন ছড়াতে অস্ত্র নয়, প্রয়োজন পরিকল্পনা ও গভীর সংযোগ। এই গোষ্ঠীগুলো কখনোই সংখ্যায় বড় হয় না। কিন্তু তারা জানে কোথায় আঘাত করতে হবে, কখন আবেগকে উস্কে দিতে হবে এবং কীভাবে প্রতীককে ব্যবহার করতে হবে। প্রতীক হয় কখনো একটি মুখ, কখনো একটি পতাকা, কখনো একটি গান, শ্লোগান বা একটি দাবি। এই প্রতীকগুলো জনগণের আবেগকে উস্কে দেয়- তাদের হতাশাকে আশায় রূপান্তর করে। পেত্রোগ্রাদে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রতিশ্রুতি, আরব স্প্রিং-এ মর্যাদার দাবি, কলম্বোতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ, ঢাকায় কোটা-বিরোধী বা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন—সবই আবেগের রাজনীতির অংশ। এই প্রতিশ্রুতিগুলোই জনগণকে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়।

বলশেভিক স্পার্ক, ১৯১৭
রাশিয়ার জার তখনও অভিজাতদের হৃদয়ে রাজা, আমলাতন্ত্রের চোখে ঈশ্বর। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর পতন লেখা হয়ে গিয়েছিল। বলশেভিক যেন নিঃশব্দে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। কারখানার ধোঁয়ার আড়ালে, সেনা ইউনিটের ছায়ায়, শহরের অলিগলিতে তারা বপন করলো বিপ্লবের বীজ।মানুষের জীবনের নিত্য অভাব, অপমান এবং জারদের নির্মমতা—এই সবকিছুর প্রতিবাদে তারা ছড়িয়ে দিলো ‘জমি, রুটি ও শান্তি’র প্রতিশ্রুতি। লেনিনের এপ্রিল থিসিস ছিলো সেই প্রতিশ্রুতির মন্ত্র যা শ্রমিকের হৃদয়ে জাগিয়ে তুললো বিদ্রোহের আগুন।অক্টোবর এলো, জার গেল।শব্দহীন বিপ্লবের সেই সুর আজও ইতিহাসের পাতায় বাজে।এই পতন কিন্তু সেনাবাহিনীর দলবদ্ধ বিদ্রোহ বা কৃষকদের বিশাল মিছিলের কারণে হয়নি। বরং লেনিনের নেতৃত্বে মাত্র ২৩ হাজার নিবেদিত বলশেভিক এই পতন ঘটিয়েছিল।
বুখারেস্ট সুনামি, ১৯৮৯
২১ ডিসেম্বর, বুখারেস্ট স্কয়ারে প্রায় এক লাখ মানুষের সমাবেশ—যেন এক নাট্যমঞ্চ, যেখানে রোমানিয়ার কমিউনিস্ট নেতা নিকোলাই চসেস্কু ছিলেন প্রধান চরিত্র। কিন্তু ইতিহাসের মঞ্চে কখনও কখনও দর্শকই হয়ে ওঠে নাট্যকার ও প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী।
চসেস্কু নিজের আধিপত্য পুনরায় নিশ্চিত করতে এই বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করেন। রোমানিয়ানদের তাদের দৈনন্দিন কাজ বন্ধ করে রেডিও এবং টেলিভিশন চালু রেখে চসেস্কুর ভাষণ শুনতে নির্দেশ দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত, এই সমাবেশটি জনবিদ্রোহের এমন এক সুনামির সৃষ্টি করে যা চসেস্কুকে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করেনি, তার জীবনের চরম পরিণতিও ডেকে আনে।
চসেস্কুর বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তিমিসোয়ারা শহরে শীতের এক বৃষ্টিমুখর দিনে। এর মূল কারণ ছিল প্রটেস্ট্যান্ট ও হাঙ্গেরীয় যাজক লাসজলো টোকসকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সরকারি চেষ্টা। টোকসের অপরাধ ছিল তিনি তার ধর্মোপদেশে চসেস্কুর শাসনের সমালোচনা করেছিলেন।
এই স্থানীয় ঘটনাটি একটি জাতীয় অনুঘটকে পরিণত হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তথ্য প্রবাহ। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের নীরবতা সত্ত্বেও “রেডিও ফ্রি ইউরোপ”-এর মাধ্যমে এই ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার লাভ করে। এই বিদেশি সম্প্রচার চসেস্কুর কঠোর সেন্সরশিপ সফলভাবে এড়িয়ে জনগণকে সব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে। এর ফলে মানুষ টোকসের বাড়ির চারপাশে সমর্থন জানাতে জড়ো হতে শুরু করে, যা “রোমানিয়ান বিপ্লব” নামে পরিচিত ঘটনার সূচনা করে।
এটি সচেতনতা এবং অসন্তোষের একটি ঢেউ তৈরি করেছিল যা জনগণকে সামষ্টিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে সবচেয়ে শক্তিশালী শাসনও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে না যদি বাইরের তথ্যের উৎসগুলো কার্যকরভাবে তাদের ব্যর্থতাগুলো প্রকাশ করে। বিদেশি গণমাধ্যমের প্রচার চসেস্কুর দুর্ভাগ্যজনক সমাবেশের আগেই জনগণের মধ্যে অসন্তোষের একটি জাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠা করেছিল।
২১শে ডিসেম্বর বুখারেস্টে অনুষ্ঠিত সেই সমাবেশটি ছিল চসেস্কুর পতনের চূড়ান্ত মুহূর্ত এবং গণমাধ্যমের প্রতিরোধের এক শক্তিশালী প্রমাণ। চসেস্কু যখন তার বক্তৃতা শুরু করেন, তখন ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন ‘বু’ করে ওঠে। চসেস্কু বিস্মিত চোখে হতবাক হয়ে যান। কিন্তু সেই একটি ‘বু‘ দ্রুতই জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাঁশি, চিৎকার এবং “তি-মি-সো-আ-রা” স্লোগানে পরিণত হয়, যা তিমিসোয়ারার সেই প্রতিবাদকেই প্রতিধ্বনিত করে। এই তিমিসোয়ারা শহরটিতেই চসেস্কুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল এক সপ্তাহেরও কম সময় আগে। তখনকার স্লোগানটি ছিল, “আজ তিমিসোয়ারাতে, কাল সারা দেশে।”
চসেস্কুর গোপন নিরাপত্তা কর্মীরা সমাবেশ থেকে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও টেলিভিশন কর্মীরা সাহসের সাথে সেই নির্দেশ অমান্য করে। তারা ক্যামেরাগুলো আকাশের দিকে ফিরিয়ে করে শব্দ রেকর্ড করা চালিয়ে যায়, যাতে মানুষ চসেস্কু এবং তার দলীয় নেতাদের দেখতে না পায়। কিন্তু অবারিত ও টানা শব্দ সম্প্রচার নিশ্চিত করেছিল যে পুরো দেশ সেই গোলমাল, ‘বু’ এবং উপহাস শুনতে পায়। এতে সারা দেশেই বিক্ষোভ সুনামির গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরের দিনই চসেস্কুর পতন হয়।
বুখারেস্টের সমাবেশটি তাই একটি গভীর প্রতীকী ঘটনাকে উপস্থাপন করে: তিমিসোয়ারার এক যাজকের উচ্ছেদ, এক বিদেশী রেডিওর প্রচার এবং এক ‘বু’—এই তিনটি সুর একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে বিপ্লবের সিম্ফনি।
চসেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনা হেলিকপ্টারে পালিয়ে গেলেও সেই দিনই ধরা পড়েছিলেন। এর মাত্র তিন দিনের মধ্যেই ২৫ ডিসেম্বর একটি সংক্ষিপ্ত এবং বিতর্কিত সামরিক ট্রাইব্যুনালের পর তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, যা রোমানিয়ার কমিউনিস্ট শাসনের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। এই বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড রেকর্ড এবং পরে সম্প্রচার করা হয়েছিল, যা বিশ্বকে হতবাক করেছিল। এই বিচার প্রক্রিয়ার গতি এবং গোপনীয়তা আজও বিতর্কিত রয়ে গেছে। শেখ হাসিনা ভারতে যেতে না-পারলে তাঁর পরিণতিও একই রকম হতো, যার প্রমাণও আজ পাওয়া যাচ্ছে তাঁর বিচারের নামে চরম দণ্ড দেয়ার প্রক্রিয়ায়।
পরের বছর ১৯৯০ সালের ১১ই মার্চ অপেরা স্কোয়ারে হাজার হাজার মানুষের এক সমাবেশে “তিমিসোয়ারা ঘোষণা” দেওয়া হয়। এটি ১৩-দফা বিশিষ্ট একটি নৈতিক দিকনির্দেশক ছিল। এতে বলা হয় যে বিপ্লবটি কেবল চসেস্কু-বিরোধী নয়, বরং চূড়ান্তভাবে কমিউনিস্ট-বিরোধী ছিল এবং এটি ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছিল। ঘোষণাটিতে সাবেক কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের সদস্যদের সরকারি পদে নিষিদ্ধ করা এবং অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের কথা জানানো হয়েছিল।তবে এই ঘোষণার অনেককিছু বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি ও সাবেক কমিউনিস্টদের উপর নিষেধাজ্ঞা—কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।
জুলাই বিপ্লব, ২০২৪
পেত্রোগ্রাদ ও বুখারেস্টের ছায়া যেন প্রতিফলিত হয় ঢাকার রাস্তায়। কিন্তু এই বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে আদর্শের চেয়ে কৌশল বড়, পরিকল্পনা চেয়ে ষড়যন্ত্র গভীর।একদল সুসংগঠিত ছাত্র ছদ্মবেশে গড়ে তোলে গোপন সেল—বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনের ভেতরে, ক্লাসরুমে, সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড়ালে, এমনকি সেনাবাহিনীর ছায়ায়। তারা জনতার ক্ষোভকে রূপ দেয় নীরব সহানুভূতিতে। মানুষের জীবনের চলমান সংকট, অভাব-অনটন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কতিপয় মন্ত্রী, আমলা, ঊর্ধতন সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এমনকি দলের তৃণমূলের নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট গভীর জনঅসন্তোষ কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের নীরব সমর্থন অর্জন করে। বলশেভিকদের ‘সবার জন্য রুটি, জমি ও শান্তি’-এর প্রতিশ্রুতির মতোই তারা বাংলাদেশে ‘বৈষম্যহীন সমাজ‘ প্রতিষ্ঠার চৌকস ও আকর্ষণীয় কিন্তু এক অবাস্তব স্বপ্ন দেখায়।
আবার বুখারেস্টে বিদ্রোহীরা যেমন চসেস্কুর সমাবেশের মিডিয়ার কল্যাণেই সারাদেশে তাদের আন্দোলনের পক্ষে মানুষের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদের চেতনা জাগিয়ে তুলেছিল, ঢাকাও তেমনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পারদর্শী ছাত্রদের এই সুসংগঠিত চক্র শেখ হাসিনা সরকারের উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তি ও নেটওয়ার্ক-এর মধ্যমেই আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তুলে- যে প্রযুক্তি ছিল উন্নয়নের প্রতীক, তা হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্র বস্তবায়নের হাতিয়ার।
মুক্তি না বিভ্রান্তি?
মস্কো থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘটনার সূচনা প্রায় অভিন্ন, কিন্তু উদ্দেশ্য ও ফলাফল একেবারেই আলাদা। রুশ বিপ্লবের মানবিকতা, রোমানিয়ান বিদ্রোহের নৈতিকতা—ঢাকায় তা হীন স্বার্থে বিকৃত।‘বৈষম্যহীন সমাজ’—এই প্রতিশ্রুতি ছিলো শুধুই এক শ্লোগান। আসলে ইতিহাস বদলের আন্দোলনের ফল সবখানে সব সময় এক হয় না- এর ফল কখনো মুক্তি, কখনো বিভ্রান্তি। পেত্রোগ্রাদে বিপ্লবের পর একনায়কতন্ত্র, বুখারেস্টে গণতন্ত্রের সূচনা, ক্যাপিটাল হিলে ব্যর্থ বিদ্রোহ, আরব স্প্রিং–এ মিশ্র ফলাফল, কলম্বোতে সরকার পতন, আর ঢাকায়—এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এতে এটাই আবারো প্রমাণ হয় যে বিপ্লবের পরের অধ্যায় নির্ভর করে নেতৃত্বের প্রকৃতি, জনগণের অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ওপর। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে তা একবারেই বিভ্রান্তির সুর।সংস্কারের শ্লোগানের আড়ালে চলছে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিকৃতি। যে ভিত্তিতে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল—সম্মিলিত সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং আপোষহীন বাঙ্গালি চেতনায়-—তা আজ সংকটে। এই পতন কেবল রাজনৈতিক নয়। এটি সাংস্কৃতিক, মানসিক ও মানবিক বিপর্যয়।এটি সেই সঙ্কট-মুহূর্ত যখন একটি জাতি তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে—যখন একটি দেশের আত্মা তার ইতিহাস ভুলে যায়। তখন কি সেই দেশের অস্তিত্ব টিকে থাকে?
ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদঃ –মতিয়ার চৌধুরী।
(আশেকুন নবী চৌধুরী একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কূটনীতিক ও লেখক-গবেষক)








