ভাষা শহীদেরা পায়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও প্রকাশিত হয়নি তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট
ভাষার জন্য বাঙালী ছাড়া আর কোন জাতি রক্ত দিয়েছ বলে আমার জানা নেই। বাঙালীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একারণেই বিশ্বের প্রতিটি মানুষ আজ নিজেদের মাতৃভাষার অধিকার পেয়েছে। প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৫২ এ বাংলার রাজধানী ঢাকায়, আর দ্বিতীয়টি ঘটে ভারতের আসামের বরাক উপতক্যার শিলচরের তারাপুর রেলষ্টেশনে ১৯৬১ এর ১৯মে।
ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৯৯ এর ১৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের শহীদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এর পর থেকে দিনটি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কমবেশী বিশ্ববাসী জানলেও ভারতের আসামের বরাক উপতক্যার এই রক্তক্ষয়ী ভাষা সংগ্রামের ইতিবৃত্ত অনেকেরই অজানা।
বাংলাদেশ এবং ভারতের ত্রিপুরা-মেঘালয়-নাগাল্যান্ড-মনিপুর ও মিজুরাম রাজ্য বেষ্টিত ব্রম্মপুত্র ও যমুনা নদী আসামের বরাক উপতক্যার মানুষকে জাতিগত ও ভাষা সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি ক্যালচারে বিভক্ত করে রেখেছে। আর একারনেই বাংলার ১৯৫২ ঈসায়ীর ভাষা আন্দোলনের অনুকরণে বরাক উপতক্যার মানুষ ভাষার জন্য সোচ্চার হয়। বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ-কাছার-হাইলাকান্দি অঞ্চলের শতকরা ৮০% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এছাড়া আসামের রাজধানী গৌহাটির সাথে সম্পুর্ন যোগাযোগ বিচ্চিহ্ন অঞ্চল হলো বরাক উপতক্যার তিনটি জেলা কাছার করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি।
স্মারকগ্রন্থ ‘কালের অভিজ্ঞান’ ও প্রাসঙ্গিক কথা
আসামের ভাষা আন্দোলনের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারন প্রথমতঃ ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ সহ বিশ্বের প্রতিটি দেশে যেমন ডিভাইড এন্ড রোল নীতিতে বিভেদ তৈরী করতে কাজ করেছে, আসামেও তারা বাঙালী এবং অসমীয়াদের মাঝে এমন কিছু বীজ বপন করেছিল তা আজও অব্যাহত রয়েছে। যদিও আসামে হাজার হাজার বছর ধরে বাঙালী-অসমীয়াসহ অন্যান্য জাতিগোষ্টী জন্মগত ভাবে যুগযুগ ধরে বসবাস করে আসছে । ব্রিটিশদের উসকানীর কারনে অসমীয়রা মনে করতে শুরু করে অসাম শুধু তাদেরই, এখানে আর করো বসবাসের অধিকার নেই। অন্যদিকে শিক্ষা চাকুরী, সভ্যতা সংস্কৃতি সবদিক দিয়ে বাঙালীরা ছিল অগ্রসর। অসমীয়ারা ভাবতে শুরু করে বাঙালীরা তাদের শোষণ করছে। তাই আসামের অসমীয়রা প্রবল ভাবে বাঙালী বিদ্ধেসী হয়ে উঠে। শুরু হয় সেই ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পূর্ব থেকেই বাঙ্গাল খেদাও আন্দোলন।
বিভিন্ন এলাকায় অসমীয়রা বাঙালীর উপর আক্রমন শুরু করে, বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক বাঙালীদের বাড়ীঘরে আক্রমন ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনায় এবং জোরপূর্বক বাঙালীদের বাড়ীঘর দখল করে। এর ফলে সমগ্র আসাম জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তীব্র আকার ধারণ করে।
এখানে আরেকটি কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় বরাক উপতক্যার মোট জনসংখ্যার ৫০.১ ভাগ হিন্দু ধর্মালম্বী ৪৮.১ ভাগ মুসলিম অন্যন্যরা খৃষ্টান। সকলেই বাঙালী এবং বাংলাভাষী। এই এলাকায় কোনদিন ধর্মনিয়ে কোন বিভেদ দেখা যায়নি, এখানে সব সময়ই বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্মৃতির অটুট বন্ধন। সকলেই বাঙ্গালীত্ব এবং ভাষার প্রশ্নে আপোষহীন। ১৯৪৭ এ দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত স্বাধীন হলে কেন্দ্রীয় ভাবে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হয় হিন্দি ও ইংরেজী অনুরোপভাবে রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যা ও জাতীয়তার ভিত্তিতে রাজ্যের সরকারী ভাষা নির্ধারিত হয়। বাঙালী অধ্যুসিত পশ্চিমবাংলা এবং ত্রিপুরায় রাজ্যের সরকারী ভাষা বাংলা করা হলেও আমামে ঘটে এর ব্যতিক্রম।
বর্ণবাদী অসমীয়রা বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধূ অসমীয় ভাষাকে রাজ্যের সরকারী ভাষা করতে চাইলে বাঙালীরা দাবী তুলে যমুনা ও ব্রম্মপুত্র অঞ্চলে রাজের সরকারী ভাষা হবে বাংলা ও অসমীয়। বর্ণবাদী অসমীয়রা তা মানতে নারাজ, এছাড়া আরো কয়েকটি কারণ উল্লেখ্য ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত সময়ের ভেতর রাজ্যের ২৫০টি বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২৭৪টি বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় আসামের রাজ্য সরকার। ১৯৫৪ এ বিধান সভা নির্বাচনে শুধু অসমীয়াকে রাজ্যের সকারী ভাষা করা প্রস্থাব করা হয়। ১৯৬০ এর অক্টোবরে আসাম বিধান সভায় আইন পাশ করা করা হয় অসমীয়া হবে রাজ্যের সরকারী ভাষা। বিধান সভায় এর প্রতিবাদ এবং বিরোধীতা করেন করিমগঞ্জের বাঙালী বিধায়ক রনীন্দ্র দাস।
১৯৬১ এ অসাম বিধান সভায় কংগ্রেসর মুখ্যমন্ত্রী বিমল প্রসাদ চলিহা আবার ঘোষণা করেন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দিু-ইংরেজীর পাশাপাশি আসাম রাজ্যের সরকারী ভাষা হবে অহমিয়া।
আর এতেই ফুঁশে উঠে বরাকের বঙ্গালীরা। ১৯৬১ এর ৫ফেব্রুয়ারী গঠিত হয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ, এই বছরের ১৪ এপ্রিল সংকল্প দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৮ মে ভাষা সংগ্রামী নলীনী দাস, রতীন সেন, বিধূভূষন চৌধুরীসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে আসাম সরকার। ১৯ মে বরাকের মানুষ শান্তিপূর্ন হরতালের ডাক দেয়। হরতাল চলাকালে দুপুর দুইটা পয়ত্রিশ মিনিটে বিনা উসকানীতে রাজ্য পুলিশ শান্তিপূর্ন সমাবেশের উপর গুলি চালায় ঘটনাস্থলে কিশোরী কমলা ভট্টচার্যসহ নিহত হন আরো ২জন। ৯ জন পরবর্তিতে মারা যান এরা হলেন চন্দ্রী চরণ সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেনন্দ্র কুমার দেব, কুমুদ রঞ্জন দাশ, তরনী দেব নাথ, সুনিল সরকার, সচীন্দ্র পাল, ধীরেন্দ্র সূত্রধর।
যদিও বাঙ্গালীদের আন্দোলনে বাধ্য হয়ে অহমিয়ার পাশাপাশি বাংলাকে রাজ্যের সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয় আজও বরাকের ভাষা শহীদেরা পায়নি রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি। যদিও সেই সময় গঠন করা হয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন আজও অজ্ঞাত কারণে সেই তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি ।








