পতনের পর – রক্তাক্ত বাংলাদেশ এবং ইউনুসের রিসেট
আমি রক্তপাতহীন একটি বাংলাদেশ কখনো দেখিনি। এই ভূ-খণ্ডে ক্ষমতার হস্তান্তর খুব কমই নির্বাচনের মাধ্যমে হয়েছে; প্রায়শই তা ঘটেছে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে। ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত কিন্তু গৌরবময় স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আর একনায়কতন্ত্রের মধ্যে দোলাচলে রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষমতা পরিবর্তনই হয়েছে শান্তিপূর্ণ উত্তরণের মাধ্যমে নয়, বরং নৃশংস বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে।
১৯৭৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস গণতান্ত্রিক অগ্রগতির নয়, বরং সহিংস অস্থিরতার এক করুণ দলিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড, পরবর্তী সামরিক অভ্যুত্থানসমূহ এবং সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাটকীয় পতন – সবই একটি কঠোর সত্যকে উন্মোচন করে: বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় না, এটি দখল করা হয়।
কিন্তু এগুলো শুধু নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঘটনা নয়। এগুলো একটি জাতির ভিত্তিকে সহিংসভাবে পুনর্লিখনের অপপ্রয়াস। ক্ষমতালোভীদের অন্ধ উচ্চাকাঙ্ক্ষা বারবার সংবিধানকে পদদলিত করেছে। তাদের স্বৈরাচারী শাসনের চাপে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নতজানু হয়েছে এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে সেখানে বিজয় পতাকা উড়িয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষমতার লড়াই হলো অতীতকে মুছে ফেলে বর্তমানকে নিজেদের মতো করে বানানোর লড়াই।
১৯৭৫: স্বপ্নভঙ্গের বছর
সদ্য স্বাধীন এবং সাড়ে তিন বছরেরও কম বয়সী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি নৃশংস ক্ষমতা দখলই ছিল না – এটি ছিল একটি জাতির জন্ম ইতিহাসকে বিকৃত করার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসনের সূচনা। এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে এমন এক যুগের সূচনা হয়েছিল যেখানে ক্ষমতা গণতান্ত্রিকভাবে অর্জন না করে দখল করা হয়েছে এবং এই অবৈধতাকে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তাঁর সঙ্গেই সমাহিত হলো। এরপর এলো একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান, যেখানে প্রতিটি ক্ষমতালোভী সামরিক শাসক সংবিধান পরিবর্তন করে স্বৈরশাসনকে আইনের আড়ালে ঢেকে দিলো। যে সংবিধান গণতান্ত্রিক ভিত্তি রচনা করবে বলে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা-ই পরিণত হলো স্বৈরশাসনের হাতিয়ারে।
বাঙ্গালি থেকে বাংলাদেশি
সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সংশোধনী আসে ১৯৭৯ সালে যখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনী পাশ করেন। এই সংশোধনী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনের সব কর্মকান্ডকে বৈধতা দেয়। এটি ছিল মূলত একটি অবৈধ শাসনকে বৈধতা দেওয়ার প্রয়াস। কিন্তু এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী – এটি জাতির আদর্শিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থান দখল করে নেয় ধর্মভিত্তিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সংবিধানে ‘ধর্ম’ শব্দটি যোগ করা হয় এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, যা জামায়াতে ইসলামীসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করে। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করলেও এর ক্ষত আজও শুকায়নি।
জেনারেল এরশাদ জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ১৯৮২ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে তিনি ১৯৮৬ সালে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে তার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেন। এই সংশোধনীসমূহের পর বাংলাদেশের সংবিধান আর গণতান্ত্রিক দলিল থাকে না। ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল একটি প্রগতিশীল প্রজাতন্ত্র গঠনের জন্য, তা পরিণত হয় ক্ষমতালোভীদের হাতিয়ারে।
জিয়া, এরশাদের পথেই হাঁটছেন ইউনুস
মুহাম্মদ ইউনূসও এই ধারা থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি সংবিধানকে ব্যক্তিগত শাসনের হাতিয়ারে পরিণত করেন। বিচারিক প্রক্রিয়ার আড়ালে তিনি পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য নয়, বরং নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য।
শেখ হাসিনার পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। কিন্তু তিনি সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত শপথ না নিয়েই এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যা সংবিধানের ৫১(১) ধারা লঙ্ঘনের শামিল।
তাঁর শপথ গ্রহণ হয় সুপ্রিম কোর্টের একটি অস্পষ্ট রেফারেন্সের উপর ভিত্তি করে, প্রতিষ্ঠিত আইনি পদ্ধতিতে নয়। ফলে তাঁর দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত নয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই নিয়োগ সংসদীয় পদ্ধতিকে উপেক্ষা করে একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করেছে, যেখানে বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সংবিধান লঙ্ঘন এবং ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এটি জাতিকে আরেকটি গভীর সাংবিধানিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ইউনূসের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখানেই থামেনি – তিনি একটি সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, বরং এটি তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করারই একটি কৌশল মাত্র। এর মাধ্যমে ইউনুস তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন- একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা, সেই উচ্চাকাঙ্খাই পূরণ করার নীলনকশা বাস্তাবায়ন করতে যাচ্ছেন। জিয়া ও এরশাদ যেমন ক্ষমতা ব্যবহার করে ‘কিংস পার্টি’ বলে অভিহিত নিজ নিজ দল গঠন করলেন, ইউনুস তা থেকে একটু ‘ডি-ট্যুর’ নিলেন। তথাকথিত ছাত্রদের দিয়ে একটি দল গঠন করালেন। যে দলটিকে ক্ষমতায় বাসানোর সব কলাকৌশল আড়াল থেকে ইউনুসের লোকজনই বাস্তবায়ন করছে। প্রতিবেশি দেশের কথিত একজন শান্তির দূত যেমন রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে নিজের দেশের চরম সর্বনাশ করে গেছেন, বাংলাদেশেও এমন ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।
২০২৪: জুলাই বিদ্রোহ
এটি আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাম্প্রতিকতম অধ্যায় মাত্র। ছাত্রনেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় হিংসাত্মক অস্থিরতায় এবং শেষ হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাটকীয় পতনের মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করলেও সমালোচিত হয় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য। এই সমালোচনাই সফলভাবে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় নামানো হয় – বাংলাদেশ এর আগে এমন বিক্ষোভ দেখেনি।
এসময় আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি যখন দেখি আন্দোলনকারীরা জাতীয় প্রতীকগুলো ভাঙতে শুরু করে। মূর্তি ভাঙা হয়, প্রতিকৃতি সরিয়ে ফেলা হয়, স্লোগান বদলে যায় – সবই ‘রিসেট’ এর নামে। কিন্তু এই রিসেটের নামে আসলে কী ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে না? এটি কি সত্যিকারের পুনর্জন্ম, নাকি বিপ্লবের মুখোশ পরা ধ্বংসের আরেকটি চক্রান্ত?

রিসেটের অন্তরালে
প্রফেসর ইউনূসের ‘রিসেট’ ধারণাটি, যা প্রাথমিকভাবে পরিবর্তনের এক আশাব্যঞ্জক বার্তা নিয়ে এসেছিল, তা দ্রুতই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এটি কেবল একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা করেনি, বরং এর প্রয়োগ পদ্ধতি এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশে নতুন করে সহিংসতা, বিভেদ এবং সাংবিধানিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। রিসেটের নামে যা ঘটছে তা গভীর প্রশ্নই তুলে ধরে: এটি কি সত্যিই সংস্কার, নাকি পুরনো চক্রান্তেরই পুনরাবৃত্তি?
একটি জাতিকে রিসেট করা আর নবায়ন করা এক নয়। নবায়নের জন্য অতীতের অর্জন ও ভুলগুলোকে স্বীকার করে এগোতে হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের এই রিসেট অতীতকে অস্বীকার করছে। ঐতিহাসিক প্রতীকগুলো শুধু একটি পতিত শাসনের চিহ্ন ছিল না – এগুলো ছিল জাতির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলো ছিল আমাদের সংগ্রাম, ত্যাগ এবং জাগরণের সাক্ষী।
বাংলাদেশ আজ ক্ষমতা দখলের এক রক্তাক্ত ময়দানে পরিণত হয়েছে। শেখ মুজিবের বাসভবন এবং তাঁর মূর্তি ভাঙা, লন্ডন দূতাবাস থেকে তাঁর বই ও প্রতিকৃতি সরিয়ে ফেলা – এগুলো সাধারণ ঘটনা নয়। এগুলো ঘোষণা করে “আমরা নতুন করে শুরু করছি”। কিন্তু একটি জাতি কি তার অতীতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এগোতে পারে? পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আমি বুঝি, কিন্তু ইতিহাস ভুলে যাওয়ার মূল্য আমি ভয় পাই। বাংলাদেশে ইতিহাস পুনর্লিখনের এই অপচেষ্টা আজ সবচেয়ে তীব্র। আমরা আবারও সেই শিকড় কাটার ঝুঁকি নিচ্ছি যা ১৯৭১ সাল থেকে আমাদের মাটির সাথে শক্তভাবে আটকে রেখেছে।
শেখ হাসিনা–পরবর্তী সহিংসতা
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে সহিংসতা শেষ হয়নি। ক্ষমতা বদলের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়—বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠী নৃশংসতার শিকার হয়েছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেকে নিহত হয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চালু করে। আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের নির্বিচার ধরপাকড় করা হয়, তাদের জেলে ঢোকানো হয়। অনেকে মব নামের চরমপন্থিদের হাতে নিহত হন। ‘সংস্কারের’ নামে ঝরানো হয় রক্ত। ‘রিসেট’ এর নামে পরিচালিত এই কর্মকাণ্ডগুলো ন্যায়বিচার বা পুনর্গঠনের পরিবর্তে প্রতিশোধের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে। সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি নিত্যদিনের নির্বিচার হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় হারিয়ে গেছে। আজকের বাংলাদেশে ইউনুসের রিসেট প্রতিহিংসার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদঃ –মতিয়ার চৌধুরী।
(আশেকুন নবী চৌধুরী একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কূটনীতিক ও লেখক)








