প্রথম অধ্যায়ঃ পতনের দিন:– ঘোষণা
লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের নিচতলার ১০ নম্বর কক্ষটি দীর্ঘদিন ধরে অনানুষ্ঠানিক, পর্দার আড়ালের আলোচনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যাকে বলা যায় আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বাইরে করিডোর কূটনীতি। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এটি পরিণত হয়েছিল একটি সংকট ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে। সেদিন সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে আমি, মিনিস্টার-কনসুলার মোহাম্মদ রাকিব উদ্দীন খান, ডিফেন্স অ্যাডভাইজার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আব্দুল মতিন, হেড অফ চ্যান্সেরি মাহফুজা সুলতানা এবং আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেখানে জড়ো হয়েছিলাম। মিনিস্টার-কনসুলারের রুম ১০-কে আমরা ঠাটটা করে “১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট” বলতাম। কিন্তু আজ সেই কক্ষের চার দেয়ালের মধ্যে হাস্যরসের কোনো স্থান ছিল না- শেখ হাসিনার সরকার পতন হয়েছে। আমি জানতাম দূতাবাসে আমার দিন শেষ। তবে এই ব্যক্তিগত আশংকা ছাপিয়ে সামনে আসে দূতাবাসের নিরাপত্তা।
‘টার্নিং পয়েন্ট’ লন্ডন বৈঠক, এপ্রিল থেকে এগিয়ে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তাব, দেশে ফিরবেন তারেক?
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের টেলিভিশন ভাষণ শেখ হাসিনা পদত্যাগ নিশ্চিত করেছে। সেনাপ্রধান বলেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেবে। তিন সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশকে কাঁপানো ছাত্র বিক্ষোভ একসময়ের অটল নেতৃত্বকে যেন এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ করলো! সেই ঘোষণা সেনাপ্রধানের ভাষণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। ছাত্রদের কোটা-বিরোধী বিক্ষোভের সময় অর্থনৈতিক ক্ষতি ও প্রাণহানির কথা স্বীকার করে তিনি বললেন, “দেশ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অর্থনীতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, অনেক মানুষ নিহত হয়েছে—এখন সহিংসতা বন্ধের সময়।”
তিনি পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার অঙ্গীকার করে আশা প্রকাশ করেন যে তার ভাষণের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে: “আমি পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছি…আমি আশা করি আমার ভাষণের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।” তিনি রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং প্রধান বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে আলোচনার কথা নিশ্চিত করলেন। এসব প্রক্রিয়া থেকে আওয়ামী লীগকে বাদ দেয়ার কথাও জানালেন।
তিনি আরও আশ্বাস দিলেন যে পরিস্থিতির উন্নতি হলে জরুরি ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে না। নাগরিকদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানালেন। বিশেষভাবে ছাত্রদের শান্ত থাকতে ও স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করার আহ্বান জানালেন। অঙ্গীকার করলেন যে বিক্ষোভের সময় সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার করা হবে। কিন্তু পরিস্থিতি তখনও উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। রাজধানীর রাস্তাগুলো, যা তিন সপ্তাহ ধরে সহিংসতা ও মৃত্যুর ভয়াল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো, সেনাপ্রধান হাসিনার পদত্যাগের খবর নিশ্চিত করতেই সেই স্থান, সারা দেশ উন্মত্ত উৎসবে ফেটে পড়ল। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো – সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো রাজধানীকে যানজটে অচল করে দিল। অনেকের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে হাসিনার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব এবং আওয়ামী লীগের কিংবদন্তিতুল্য রাজনৈতিক দুর্গ মাত্র তিন সপ্তাহের ছাত্র-আন্দোলনের ধ্বসে পড়তে পারে। উল্লসিত-উন্মত্ত জনতা বিনা-বাধায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়ল। তারা ফার্নিচার, টেলিভিশন, চেয়ার ইত্যাদি বের করে বিজয়গর্বে মাথার উপর তুলে নিল। সারাদেশে আওয়ামী লীগের অফিস লুট করা হলো, মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা করা হলো, দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করা হলো।
২০২৪: যখন বাংলাদেশ ধ্বংস হলো (১ম পর্ব)
লন্ডন দূতাবাসে দিনটি সেনাপ্রধানের টেলিভিশন ভাষণের পরপরই হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম আমাকে ফোন করে পরামর্শ দিলেন যে আমরা, ঊর্ধ্বতন কূটনীতিকরা, দূতাবাসে মিলিত হই। তবে তিনি বললেন ডিফেন্স অ্যাডভাইজারের পরামর্শে তিনি আসবেন না। ডিফেন্স অ্যাডভাইজার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মতিনও আমাদের জানান তিনি হাইকমিশনারকে দূতাবাসে না আসার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ তিনি আশঙ্কা করেছেন যদি বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা দূতাবাসে আসে এবং তাকে সেখানে দেখে, তবে তারা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, অপমান করতে পারে এবং মিশন ভাঙচুর করতে পারে, যেমনটি তারা কয়েক বছর আগে করেছিল। পতনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জননিরাপত্তা ও উত্তেজনা কমানোর জন্য ৫-৬ আগস্ট দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করেছিল। তবে আমরা বৈদেশিক মিশন সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা পাইনি। ফলস্বরূপ কনস্যুলার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নির্ধারিত ছিল এবং অনেক মানুষ সেবা নিতে দূতাবাসে এসেছিল।
কিন্তু নিরাপত্তার জন্য দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এতে অনেকে ক্ষুব্ধ হন। এক পর্যায়ে আমি ও হেড অফ চ্যান্সেরি মাহফুজা সুলতানা বাইরে গিয়ে ফুটপাতে অপেক্ষমানদের বুঝিয়ে বলি যে, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে সার্ভার বন্ধ থাকায় আমরা সেবা দিতে পারছি না। অনেকে জানান তারা অনেক দূর থেকে এসেছেন এবং এখনই সার্ভিস চান। আমরা আমাদের অসহায়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করলাম। ব্যাখ্যা করলাম যে বাংলাদেশে সার্ভার চালু না-হওয়া পর্যন্ত সেবা পাওয়া যাবে না। আরও আলোচনার পর সেবা প্রত্যাশীরা অবশেষে চলে গেলেন। আমরা প্রতিশ্রুতি দিলাম যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ভিতরে ফিরে আমরা আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করি। আমরা কি আমাদের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারব? আমরা কি দূতাবাস রক্ষা করতে পারব? কয়েক ঘন্টা পর হাইকমিশনার দূতাবাসে আসেন। তবে তিনি তার নিজের অফিসে না গিয়ে দূতাবাসের ২৭ কুইন্স গেটের নতুন ভবনে বসেন।
আমি আমার বিভিন্ন সোর্সের সাথে যোগাযোগ করলাম- লন্ডনে বিএনপি ও জামায়াত অনুসারীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য জানতে চাইলাম। একজন যুক্তরাজ্য বিএনপি-র সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মালিকের সাথে কথা বলে জানালেন যে হাইকমিশনে তাৎক্ষণিক কোনো বিক্ষোভের পরিকল্পনা তার দলের নেই। তবে শহরের অন্য কোথাও সমাবেশ করা হবে। এই তথ্য জানার পরও আমরা সতর্কতামূলক নানা ব্যবস্থা নিলাম। এরপর সন্ধ্যায় বাসার পথে রওয়ানা হওয়ার আগে একে অপরের সাথে নিবিড় যোগাযোগ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়ি ফেরার পথে আমার ফোনের স্ক্রিনে উল্লাসে উন্মত্ত ঢাকার রাস্তার চিত্র ভেসে ওঠলো- শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে গেল।
প্রায় তেতাল্লিশ বছর আগে তিনি ভারত থেকে ফিরে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত নেতা হিসেবে। বাংলাদেশের মাটিতে যখন পা রেখেছিলেন তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ “জয় বাংলা” স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে ছিলো। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মানুষের ভবিষ্যতের আশা ও ভরসার প্রতীক। আজ তিনি একটি সামরিক হেলিকপ্টারে তার বোন শেখ রেহানার সাথে আবার রওনা দিলেন- ভারতের পথে। কোথায় সেই জনতা- কোথায় সেই স্লোগান। তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন সফল নেতা হিসেবে নয়, পতিত শাসক হিসেবে। জানেন না আর কোনদিন ফিরতে পারবেন কী-না!
তার দীর্ঘদিনের লালিত ছিল প্রিয় মাতৃভূমিতে—তার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার শান্ত-শ্যামল প্রকৃতির মধ্যে শেষ দিনগুলো কাটানো।
(আশেকুন নবি চৌধুরী একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কূটনীতিক ও লেখক। যোগাযোগ জন্য এমেইল করতে পারেন-ashikbss@gmail.com)।
ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদঃ –মতিয়ার চৌধুরী।
পরবর্তী পর্ব: ২২ জুন, ২০২৫: শেখ হাসিনার জন্য শেষ মুহূর্তের কূটনীতি ইউকে ফরেন অফিসে বৈঠক
(সম্পূর্ণ বইটি ২০২৫ সালের আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবে।