শহরের রাস্তায় বিলবোর্ডে লেখা—‘দেশে চলছে উন্নয়নের জোয়ার’। অথচ পাশের স্কুলে শিক্ষক বেতন পান না, রোগী চিকিৎসা পায় না। উন্নয়নের এই বিভ্রমই আমাদের সংস্কারের মুখোশ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের আঁকা ছবিগুলো যেন বাস্তব ক্রেস্ট। সংস্কারের কথা এখন আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। শিক্ষা সংস্কার, আইন সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, নির্বাচন সংস্কার—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংস্কারের ডাক শোনা যায়। নীতিনির্ধারকেরা সভা-সেমিনারে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন, পরিকল্পনা কমিশন থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত সংস্কারের খসড়া তৈরি হয়, গঠন হয় নানা কমিটি, কমিশন ও টাস্কফোর্স। কিন্তু বাস্তব চিত্র বড়ই হতাশাজনক। এতসব সংস্কারের পরও শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি, আইনের প্রয়োগে বৈষম্য, নির্বাচনে অবিশ্বাস, প্রশাসনে স্বজনপ্রীতি ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য—সবকিছু আগের মতোই রয়ে গেছে। প্রশাসনিক পদোন্নতিতে স্বজনপ্রীতি, নির্বাচনে অর্থের প্রভাব—সবকিছু আগের মতোই রয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠছে—কেন কোনো সংস্কারই স্থায়ী বা কার্যকর হতে পারছে না?
এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ডের দিকে তাকাতে হয়। মূল সমস্যাটি কাঠামোগত নয়, মানসিক ও নৈতিক। আমরা যতই আইন পরিবর্তন করি, বিধি-নিষেধ জারি করি, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি—যতক্ষণ না মানুষের মনে সততা, ন্যায় ও দায়িত্ববোধের মূল্যবোধ জাগ্রত হয়, ততক্ষণ কোনো সংস্কারই ফলপ্রসূ হবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যক্তিদের ভেতরে লোভ ও মিথ্যার যে গভীর শিকড়, সেটিই সংস্কারের সবচেয়ে বড় বাধা। এই লোভের সংস্কার না ঘটলে শিক্ষা সংস্কার হোক বা আইন সংস্কার—সবই হবে কেবল মুখোশ, যার আড়ালে থাকবে পুরোনো অসত্যের রাজত্ব।
লোভ মানবজীবনের এক প্রাচীন দোষ। কিন্তু যখন ব্যক্তিগত লোভ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে, তখন সেটি শুধু ব্যক্তির নয়, জাতিরও পতন ডেকে আনে। আমরা দেখেছি—একজন শিক্ষানীতিনির্ধারক যদি নিজের স্বার্থ বা রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দেন, তবে শিক্ষা সংস্কার কাগজে সীমাবদ্ধ থাকে; একজন আইনপ্রণেতা যদি ন্যায়বোধের বদলে ক্ষমতার স্বার্থ দেখেন, তবে আইন সংস্কার রূপ নেয় বৈষম্যের নতুন যন্ত্রে; নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা যদি নিরপেক্ষতার বদলে ব্যক্তিগত সুবিধা খোঁজেন, তবে গণতন্ত্র রূপ নেয় প্রহসনে। ফলে সংস্কারের ভাষা যতই উচ্চারণ করা হোক, তার আত্মা থেকে যায় মৃত।
মিথ্যা হচ্ছে লোভের যমজ ভাই। এই মিথ্যা আজ সমাজে এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে যে, সত্য বলা যেন বোকামির পরিচায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, এমনকি শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত—সব জায়গায় এখন মিথ্যার চর্চা একধরনের ‘চালাকি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মানুষ বিশ্বাস করতে শিখেছে যে, সফল হতে হলে সত্য নয়, চাতুর্যই শ্রেষ্ঠ। এই সংস্কৃতিই সমাজের গভীরে পচন ধরিয়েছে। যখন সত্য ও ন্যায়কে দূরে সরিয়ে মিথ্যা ও সুবিধাবাদকে মূল্য হিসেবে স্থাপন করা হয়, তখন কোনো সংস্কারই টিকে থাকতে পারে না। কারণ, সংস্কার কেবল কাঠামো নয়—সংস্কার মানে মানসিক পরিবর্তন, আত্মশুদ্ধি, নৈতিক পুনর্জাগরণ।
আমরা ভুলে যাই, রাষ্ট্র কেবল একটি প্রশাসনিক কাঠামো নয়—এটি এক নৈতিক সত্তা। রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্মচারী, শিক্ষক, রাজনীতিক বা নাগরিক এই নৈতিকতার অংশ। তাই সংস্কারের মূল শুরু হওয়া উচিত ব্যক্তিমানুষের ভেতর থেকে। যখন একজন শিক্ষক সৎভাবে শিক্ষাদান করেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন, একজন রাজনীতিক সত্যিকারের জনসেবায় নিবেদিত থাকেন—তখনই সমাজে নৈতিক সংস্কার ঘটে। এর বিপরীতে, যখন এরা নিজেদের স্বার্থকে জনস্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখেন, তখন সকল সংস্কারের অর্থহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সংকট হলো—আমরা সংস্কারের বাহ্যিক দিক নিয়ে যতটা উৎসাহী, অন্তর্গত দিক নিয়ে ততটাই উদাসীন। শিক্ষা সংস্কার মানে কেবল পাঠ্যসূচি পরিবর্তন নয়; আইন সংস্কার মানে কেবল নতুন ধারা যোগ নয়; নির্বাচন সংস্কার মানে শুধু প্রযুক্তিগত আপডেট নয়—এর অর্থ হচ্ছে ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা, সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং ক্ষমতার প্রতি সংযম। কিন্তু আমরা যদি এই নৈতিক দিকটিকে অগ্রাহ্য করি, তবে যত পরিবর্তনই ঘটুক, সেগুলো টেকসই হবে না। সংস্কার তখন রূপ নেবে একধরনের নাটক বা প্রদর্শনীতে, যেখানে আসল পরিবর্তনের বদলে দেখা যাবে কেবল সাজসজ্জা।
গান্ধী বলেছিলেন, ‘নৈতিকতা ছাড়া রাজনীতি এক প্রকার সহিংসতা।’ আজ আমাদের সমাজে সেই সহিংসতারই বিস্তার ঘটেছে।এখানে সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষের দায়িত্ব রয়েছে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও প্রশ্ন করতে হবে—আমরা কি নিজের জীবনে সত্য ও সততার চর্চা করছি? আমরা কি নিজেদের পেশায় সৎ ও দায়িত্বশীল? সমাজ যদি সত্যের পথে না হাঁটে, তবে রাষ্ট্রও মিথ্যার কাদায় ডুবে যাবে। তাই লোভ ও মিথ্যার সংস্কার শুধু শাসক শ্রেণির নয়, এটি প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।
আজ আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন আন্দোলনের—যে আন্দোলন নৈতিকতার। এই আন্দোলনের শিকড় হবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই যদি সন্তানদের শেখানো যায় যে সৎ থাকা মানেই শক্তিশালী হওয়া, সত্য বলা মানেই সাহসী হওয়া—তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মই গড়ে তুলবে এক সত্যনিষ্ঠ সমাজ। রাষ্ট্র তখন প্রকৃত অর্থে ন্যায় ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হবে।
আমরা সবাই সংস্কারের কথা বলি, কিন্তু নিজের জীবনে কতটা সত্যকে আঁকড়ে আছি? আমার নিজের মধ্যে যদি মিথ্যার চাষ থাকে, তবে সমাজে সত্যের বীজ কীভাবে অঙ্কুরিত হবে? সংস্কারের কাগজ যতবার বদলায়, মানুষ ততবার একই মিথ্যার ছায়ায় হাঁটে। তাই সংস্কারের মূলে সবার আগে প্রয়োজন আত্মসংস্কার, বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র—এই তিনের মধ্যকার নৈতিক বন্ধনই যে কোনো পরিবর্তনের ভিত্তি। আমরা যদি সত্য ও ন্যায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই, তবে সব ধরনের সংস্কারই সফল হবে; কিন্তু যদি মিথ্যা ও লোভকে আশ্রয় দিই, তবে সবচেয়ে মহৎ সংস্কার পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই বলা যায়—যে সমাজ লোভ ও মিথ্যার সংস্কার করতে পারে না, সেই সমাজের কোনো সংস্কারই টিকে না। তবু আশা হারানো যায় না; সত্য ও ন্যায়ের পথের পথিকরা আজও আছেন—তাদের আলোই একদিন এই অন্ধকার ভেদ করবে।
সুধীর বরণ মাঝি, শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।








